এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) : চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে সরকারি জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে আরশি নগর ফিউচার পার্ক নামের বাণিজ্যিক বিনোদন কেন্দ্র। পার্কের একদিকে রেলওয়ের জমি অন্যদিকে সড়ক ও জনপদ বিভাগের (সওজ) জমি।

পার্কে রয়েছে শিশু কিশোর-নারী পুরুষদের অবাদ বিচরণ। ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে শিশুদের জন্য নানা রকম খেলার রাইডার। অথচ এর উপর দিয়ে বয়ে গেছে ২ লক্ষ ৩২ হাজার কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। যার দরুন এখানে যে কোন সময় ঘটতে পারে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। বিনোদনের নামে রাতের বেলায় চলে অসামাজিক যত কর্মকান্ড। করোনা পরিস্থিতির দরুন সরকারের দেয়া লকডাউন অমান্য করে এখনো দিব্বি খোলা রাখা হয়েছে পার্কের সবধরণের বাণিজ্যিক কাজকর্ম।

জানা গেছে, মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড় এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের মাঝখানে সওজ ও রেলওয়ের জমি দখল করে আরশিনগর ফিউচার পার্কটি নির্মাণ করা হয়েছে।

পার্কটির প্রতিষ্ঠাতা নাসির উদ্দিন দিদার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ রয়েছে সরকার দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তিনি অবৈধভাবে পার্কটি নির্মাণ করেছেন।


সওজ ও রেলওয়ের জমি দখল করে পার্ক নির্মাণ

সওজ ও রেলওয়ের জায়গায় নির্মিত পার্কটির কাজ ইতোমধ্যে ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। গত দুই বছর ধরে দর্শনার্থীরাও টিকিট কেটে সেখানে যাতায়াত করছে। অজানা কারণে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ে, সড়ক ও জনপদ বিভাগ দোদন্ড প্রতাপশালী এ সরকার দলীয় নেতার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

এ ছাড়া জবরদখল করা সরকারি সম্পত্তিও উদ্ধার করেনি। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামের কানুনগো কাউচার হামিদ বলেন, ‘আরশি নগর ফিউচার পার্ক কর্তৃপক্ষকে আমরা দুই দুইবার উচ্ছেদ নোটিশ দিয়েছি। করোনা পরিস্থিতির জন্য আর উচ্ছেদ করা হয়নি। আশা করছি সহসা রেলওয়ের জমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হবে।’

অবশ্য এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা কঙ্কন চাকমা বলেন, ‘রেলওয়ের জায়গা অবৈধভাবে দখল করার সুযোগ নেই। অবশ্যই এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এদিকে সরকারের সড়ক ও জনপদ বিভাগের (সওজ) জমি দখল করে তৈরি করা হয়েছে পার্কের দৃষ্টিনন্দন ফটক, আউটডোর শপ ও পার্কিংসহ নানা স্থাপনা। তাতেও সরকারের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কোন মাথা ব্যাথা নেই। কেন এতদিন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ জমি উদ্ধারে চেষ্টা করেনি তারও উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে এতদিন পরে হলেও সওজের জমি দখলের বিষয়ে আরশি নগর ফিউচার পার্ক কর্তৃপক্ষকে উচ্ছেদের নোটিশ দেয়া হবে বলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডি) রোকন উদ্দিন খালেদ চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে পার্ক এলাকায় লোক পাঠিয়েছি। দু’একদিনের মধ্যে উচ্ছেদ নোটিশ দেয়া হবে। কার্যকর ব্যবস্থাও নেয়া হবে।’


বিনোদনের নামে রাতে চলে অসামাজিক কার্যক্রম

আরশি নগর ফিউচার পার্ক এর অভ্যন্তরে বেশ কিছু কটেজ স্থাপন করা হয়েছে। যাতে সুযোগ রাখা হয়েছে রাত্রিকালীন অবকাশ যাপনের। চলতি বছর ২০ মার্চ পার্কে বেড়াতে গিয়ে ১৫ বছর বয়সি এক স্কুল ছাত্রী শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছিলেন।

এ ঘটনায় স্থানীয় জোরারগঞ্জ থানায় ওই শিক্ষার্থী বাদী হয়ে একটি মামলাও দায়ের করেন। পরবর্তীতে পার্ক কর্তৃপক্ষ নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির দরুন এ ঘটনা দামাচাপা দেয়। থানা পুলিশের তরফ থেকেও এ বিষয়ে এখনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

তবে মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থানার ওসি নূর হোসেন মামুন বলেন, ‘বিষয়টি এখনো তদন্ত চলছে।’ পার্কের অভ্যন্তরে থাকা কটেজে বিনোদনের নামে অসামাজিক কর্মকান্ড সম্পর্কে ওসি বলেন, ‘এ ধরণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমরা পাইনি। পেলে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এদিকে করোনাকালীন লকডাউনের সময় আরশি নগর ফিউচার পার্ক দিব্বি খোলা রাখার দরুন মিরসরাই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সুবল চাকমা দুই দফা অভিযান চালান। অভিযানের সময় পার্কে থাকা লোকজনকে বের করে দিয়ে পার্কের স্বত্তাধিকারী নাছির উদ্দিন দিদারকে পার্কের সব ধরণের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে সতর্ক করলেও তিনি পার্কের সকল কার্যক্রম চালিয়ে যান।

এ বিষয়ে সুবল চাকমা বলেন, ‘আমরা দুই দফা ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে পার্কে অভিযান চালিয়ে পার্কে থাকা লোকজনকে বের করে করে সতর্ক করেছিলাম। এবার আইন অমান্য করলে পার্ক কর্তৃপক্ষকে জরিমানা করা হবে।’


জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের নীচে খেলার রাইডার

পার্কটি ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে শিশুদের জন্য নানা রকম খেলার রাইডার। অথচ এর উপর দিয়ে বয়ে গেছে ২ লক্ষ ৩২ হাজার কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। যদিও বা সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছে জাতীয় গ্রীডের নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে কোন স্থাপনা আইনত অপরাধ। এর দরুন যেকোন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যার জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হবে তেমনি পার্কের মত জায়গায় জানমালের বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।

এ বিষয়ে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রীড চট্টগ্রামের বারআউলিয়া কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রকৌশলী হাসমত উল্লাহ বলেন, ‘এটি ২ লক্ষ ৩২ হাজার কেভি ক্ষমতা সম্পন্ন লাইন। এটির নিচে কোন স্থাপনা করার নিয়ম নেই। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।’

সম্প্রতি পার্ক এলাকায় গিয়ে নাছরিন আক্তার নামে এক দর্শনার্থীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘এলাকায় আর কোন পার্ক না থাকায় বাচ্চাদের নিয়ে এখানে আসতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ লাইন আছে দেখেছি কিন্তু এটার কারণে কি ক্ষতি হবে তাতো ভাই আমরা জানি না।’

এদিকে বেশ কয়েকদফা আরশি নগর ফিউচার পার্ক কর্তৃপক্ষকে মিরসরাই উপজেলা প্রশাসনের তরফ থেকে মৌখিকভাবে সতর্ক করার পরও তারা একে একে কটেজ, খেলার রাইডার, বেবি শপ, চকলেট শপ, রেষ্টুরেন্ট, ফুডজোন, কৃত্রিম লেক, কমিউনিটি সেন্টার, মুক্ত মঞ্চ তৈরি করে সেখানে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

এসব প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘আরশি নগর ফিউচার পার্ক নামের প্রতিষ্ঠানটি পুরোটাই অবৈধভাবে স্থাপন করা হয়েছে। এ ধরণের জায়গায় পার্ক কোনভাবেই থাকতে পারে না। বিদ্যুৎ বিভাগ এর জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে।’

জমি দখলসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে পার্কের কর্ণধার মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক নাছির উদ্দিন দিদারের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘১৯৮৪ সাল থেকে রেলওয়েকে আমি খাজনা দিয়ে বৈধভাবে জমি ব্যবহার করছি। সওজের জায়গা আমার পার্কের সামনের অংশে। এরকম অনেক কোম্পানী রেলওয়ে সওজের জমি দখল করে ভবন করছে। কারো বিরুদ্ধেতো কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সরকারি নিষেধাক্কার মধ্যে পার্ক চালু রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ম্যাজিষ্ট্রেট অভিযান চালানোর পর তিনি পার্ক বন্ধ রেখেছেন।’