ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান

কোন কাজের অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মেধা, শ্রম ও সময়কে সদ্ব্যবহার করে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের মৌলিক ক্ষমতাকে দক্ষতা বা Skill বলে। যে কোন মানুষের জীবনে সাফল্য আনতে হলে পেশাগত জ্ঞানদক্ষতার উন্নয়ন প্রয়োজন। পেশাগত দক্ষতা অর্জন ব্যতীত প্রকৃত সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। একথাটি অন্যান্য পেশার ন্যায় শিক্ষা পেশায়ও সমভাবে প্রযোজ্য।

কেননা শিক্ষাদান করাও একটি মহান পেশা। যে পেশার উন্নয়নে জ্ঞানদক্ষতার প্রয়োজন। একজন শিক্ষককে তার পেশার উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিনিয়ত নব নব জ্ঞান ও কৌশলের সন্ধান করতে হয়। পাঠদানকে শতভাগ সফল করতে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও আধুনিক জ্ঞান গবেষণার সন্ধানে নিরলস প্রচেষ্টায় নিজেকে নিরত রাখতে হয়।

শিক্ষকের পেশাগত মূল্যবোধ, আত্মপ্রত্যয় ও বোধগম্যতার সমন্বয় ঘটিয়ে শ্রেণী পাঠদান সার্থক করতে হয়। আর এসব পদ্ধতি ও কৌশলকে আয়ত্ব করতে হলে শিক্ষকের জ্ঞানদক্ষতার উন্নয়ন করতে হয় এবং যথাসময়ে যথোপযুক্ত পাত্রে প্রায়োগিক দিকেও নজর দিতে হয়। তাই একজন শিক্ষকের জ্ঞানদক্ষতার উন্নয়ন সাধনের জন্য যেসব বিষয়ে প্রাধিকার ভিত্তিতে নজর দিতে হবে তা হচ্ছে-

পেশাগত মনোভাব
যে কোন পেশায় নিযুক্ত হওয়ার পূর্বেই সে পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজ পেশার সাথে মনকে গভীরভাবে নিবিষ্ট করা প্রয়োজন। নতুবা সেই পেশায় টিকে থাকা কিংবা পেশা থেকে কাক্সিক্ষত ফলাফল আশা করা দুরাশায় পর্যবসিত হয়। তদ্রুপ একজন শিক্ষককেও পেশা হিসেবে শিক্ষণ শুরু করার প্রারম্ভেই তার পেশাগত মনোভাব গঠন করা অপরিহার্য।

পেশাগত মনোভাবের যেসব বৈশিষ্ট্য আছে শিক্ষক যদি তার শিক্ষণের সূচনা থেকে নিষ্ঠার সাথে সেসব বৈশিষ্ট্য ধাপে ধাপে অর্জন করতে থাকেন তবে একজন সফল শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না।

মনে রাখতে হবে, যারা পেশাগত মনোভাব ব্যতীত শিক্ষকতাকে কেবল বেঁচে থাকার সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে বেছে নেয়, তারা কখনই শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে কিংবা শ্রেণীকক্ষে উন্নততর পাঠদান করতে পারে না। যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক হিসেবেও নিজেদেরকে তারা কখনো প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

আত্ম-মূল্যায়ন
শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যে দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে তা হচ্ছে- self-evaluation বা আত্ম-মূল্যায়ন। কেননা শিক্ষক যোগ্যতা অর্জন নিশ্চিত করার জন্য সহজতর ও অতীব কার্যকরী উপায় এটি। শিক্ষক এর দ্বারা যোগ্যতা অর্জনের প্রতিটি পদক্ষেপে সচেতন বিশ্লেষণ করতে পারেন ও প্রয়োজনীয় কৌশল ব্যবহার করে যোগ্যতার উন্নয়ন ঘটাতে পারেন।

প্রসিদ্ধ লিকার্ট স্কেল এ ক্ষেত্রে একটি কার্যকরী কৌশল হতে পারে। কেননা এর মাধ্যমে শিক্ষক তার অর্জিত যোগ্যতার মান পর্যবেক্ষণ পূর্বক নিজেকে যোগ্যতার সর্বোচ্চ মানে উন্নীত করার প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন ও অনুশীলন করতে পারেন। দক্ষতা উন্নয়নের জন্য একজন শিক্ষককে অবশ্যই জ্ঞান জগতের নব নব দিগন্তে প্রবেশ করে সর্বশেষ শিক্ষণ প্রযুক্তি ও গবেষণার তথ্য-কৌশল আয়ত্ব করতে হবে।

এতদ্ব্যতীত শিক্ষক পেশায় অর্থোপার্জনের মাধ্যম হিসেবে তার উপস্থিতি দীর্ঘ করতে পারবেন বটে কিন্তু নিজস্ব উৎকর্ষতার দ্যুতি বিস্তৃত করতে পারবেন না। তার দ্বারা নিজের ভেতরে থাকা দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে কর্মসহায়ক গবেষণার মাধ্যমে এর উন্নয়ন ঘটানো কখনো সম্ভব হবে না।

আধুনিক শিক্ষা মনোবিদের মতে, একজন শিক্ষকের আত্ম-মূল্যায়ন এর গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। Arends বলেছেন : ″Efictive teaching requires careful and reflective thought about what a teacher is doing and the efect of his or her action on students, social and academic learning″ অর্থাৎ শিক্ষক কী করছেন এবং শিক্ষকের কার্যাবলি শিক্ষার্থীর সামাজিক ও একাডেমিক শিখনে কী প্রভাব ফেলছে তার উপর নির্ভর করে কার্যকর শিক্ষণ। (মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ মডিউল, পৃ. ১৪৩)
এ প্রসঙ্গে Wong বলেছেন :

″Touch the life of a student, and you will have a student who will learn history, physical education and even science and math, clean the erasers, staple all the papers and turn wheel to please you″. অর্থাৎ শিক্ষক হিসেবে আপনি আপনার শিক্ষার্থীর স্পন্দন স্পর্শ করার চেষ্টা করুন। এতে করে আপনি এমন এক শিক্ষার্থীকে পাবেন যে ইতিহাস, শারীরিক শিক্ষা, বিজ্ঞান, গণিত সব শিখবে, নিজের অন্যসব কাজ করেও আপনাকে খুশি রাখবার সব রকম প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে। (মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ মডিউল, পৃ. ১৪৩)

পেশাগত জ্ঞানার্জন
পেশায় স্থায়ীত্ব কিংবা উন্নয়ন কাক্সিক্ষত হলে পেশাগত জ্ঞানার্জন পূর্বক দক্ষতা অর্জন বাঞ্ছিত হওয়া প্রয়োজন। পেশাগত জ্ঞানার্জন যেহেতু একটি ধারাবাহিক চলমান প্রক্রিয়া সেহেতু পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য শিক্ষককে নিজ বিষয়ের সর্বশেষ অগ্রগতি ও বিকাশমান ধারণার সমন্বয়ে নিজেকে Uptodate বা হালনাগাদ রাখতে হবে। শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় বর্তমান পদ্ধতি ও গবেষণার ফলাফল জানতে হবে।

শিক্ষামূলক অভীক্ষা ও এর ব্যাখ্যা এবং শিক্ষাক্রমের ওপর জ্ঞান থাকাও জরুরি। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি এবং সম্প্রদায় ও পরিবেশগত উন্নয়ন সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞানার্জন করতে হবে। জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষককে সৃজনশীল হওয়া প্রয়োজন। গতানুগতিক ধারার জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এনে সৃষ্টিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সৃজনশীল জ্ঞান উপহার দেয়া প্রয়োজন।

শিক্ষক সৃজনশীল মনোভাবের হলে যে কোন বিষয়কে তিনি চিন্তা ভাবনার জগতে প্রবেশ করিয়ে সৃজনশীল ফলাফল বের করে আনতে সক্ষম হবেন। মনে রাখতে হবে, বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারা একজন ভাল শিক্ষকের প্রাত্যহিক ব্রত হওয়া উচিত।

ব্যক্তিগত দর্শন
ব্যক্তিগত দর্শন শিক্ষণ প্রক্রিয়ার উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শিক্ষকের ব্যক্তিগত দর্শন শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নকে যেমন ত্বরান্বিত করে তেমনি শিক্ষণ-শিখনের নতুন নতুন চমৎকার দিকগুলোর মিথস্ক্রিয়ায় শিক্ষকের মাঝে উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃষ্টিশীল অদম্য কর্মোদ্দীপনার উন্মেষ ঘটায়।

শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা উন্নয়নে ব্যক্তিগত দর্শন ব্যক্তিকে সাহসী ও উন্নয়ন প্রয়াসী হতে সাহায্য করে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকের ব্যক্তিগত দর্শনে তিনি কেবল শিক্ষাদাতা বা জ্ঞানদাতা নন, তিনি শিক্ষার্থীর সহকর্মী, হিতৈষী বন্ধু, জ্ঞান বিকাশে সহায়তাকারী, তার জীবনদর্শন গঠনের প্রধান সহায়ক এবং তার কর্ম প্রচেষ্টার সুবিজ্ঞ পথ নির্দেশক।

শিক্ষার্থীর জ্ঞানমূলক বিকাশ ছাড়া তাদের বিশেষ ক্ষমতাগুলোকে বিকশিত করা এবং তাদের মধ্যে সহযোগিতা, বন্ধুপ্রীতি, স্বার্থকতা, অনুভূতিমূলক একতা বজায় রাখা প্রভৃতি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো শিক্ষকের ব্যক্তিগত দর্শনের প্রধানতম দিক। তাই বলা যায়, শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন ও কল্যাণের অন্যতম সোপান হচ্ছে ব্যক্তিগত দর্শন।

ব্যক্তিগত মূল্যবোধ
মূল্যবোধ বলতে বোঝায়, কোন ব্যক্তির নৈতিক গুণাবলি সমৃদ্ধ উপলব্ধ জ্ঞান যা তার অন্তরে লালিত হয়। এটা ব্যক্তিজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার। মূল্যবোধ শিক্ষককে দায়িত্ব পালনে ব্রতী করে এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে প্রেরণা যোগায়। এ কারণে Values বা মূল্যবোধে বিশ্বাসী হওয়া কিংবা শিক্ষার্থীর মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারা সুশিক্ষকের পরিচায়ক।

নিজের ভেতরে মূল্যবোধ লালন এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে মূল্যবোধের বিস্তরণ ঘটাতে পারাই আদর্শ শিক্ষকের অন্যতম ব্রত। মূল্যবোধহীন শিক্ষা দ্বারা শিক্ষার্থীদের পার্থিব জগতের নানা সফলতা অর্জিত হলেও শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্য ব্যহত হয় চরমভাবে।

তবে শিক্ষকের মূল্যবোধ সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আত্মসম্মান ও শৃংঙ্খলার মত মহৎ গুণাবলি তৈরিতে ইতিবাচক অবদান রাখবেন। মনে রাখতে হবে, একজন শিক্ষকের মূল্যবোধ অবশ্যই তার স্বকীয় সত্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।

শিক্ষকের মধ্যে মূল্যবোধ জাগরিত হয়েছে তখনই ধর্তব্য হবে যখন শ্রেণীকক্ষে পাঠপরিচালনায় শিক্ষক দেহমনকে গভীরভাবে নিবিষ্ট করবে এবং যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট জাতীয় লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সফলতার সোপানে পৌঁছানো যাবে সে প্রক্রিয়া রপ্ত করবে।

অতএব বলা যায়, মূল্যবোধ বলতে জ্ঞানের বহুমাত্রিকতা, উচ্চতর নৈতিক গুণাবলি এবং সচেতন ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতাকে বোঝায়। এটা জাতীয় দর্শন এবং শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মূল্যবোধ ব্যক্তির মধ্যে শক্তির সন্ধান করে এবং অন্যের মধ্যে বিকশিত করতে অনুপ্রাণিত করে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে মূল্যবোধের বিকাশ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মূল্যবোধ ও দর্শন দ্বারা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রভাবান্বিত করতে পারেন খুব সহজে। এটি শিক্ষার্থীর জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে, তাদের সার্বিক উন্নয়নের সহায়ক শক্তিরূপে বিবেচ্য।

শিক্ষাবিদদের মতে, উপযুক্ত শিক্ষণÑশিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কমপক্ষে সাত ধরণের মূল্যবোধ বিকশিত হওয়া প্রয়োজন। যেমনÑঅর্থনৈতিক মূল্যবোধ, শারীরিক ও বিনোদনমূলক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক মূল্যবোধ, নান্দনিক মূল্যবোধ, বৌদ্ধিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ইত্যাদি।

পেশাগত দায়িত্ববোধ
মেধা, প্রজ্ঞা ও জ্ঞান-দক্ষতায় পরিপূর্ণ শিক্ষক হচ্ছে দেশ ও জাতির অমূল্য মানবসম্পদ। জাতির বুনিয়াদ গঠনে ও জাতীয় ঐতিহ্য লালনে শিক্ষকের ভূমিকা যে কোন পেশাজীবীর চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা দেখতে পাই শিক্ষক মানুষ গড়ার ইন্ডাস্ট্রিতে নিত্যদিনের সেবাব্রতী এবং পেশাগত দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য নিষ্ঠায় সদা অগ্রবর্তী।

শিক্ষক পেশাগত দায়িত্ব পালনের একাগ্রতা এবং আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ নিষ্ঠার কারণে সর্বসাধারণের কাছে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার পাত্র। এসব কারণে একজন শিক্ষকের যথেষ্ট দায়িত্ববোধ বা Responsibility থাকা প্রয়োজন। গতানুগতিক ধারায় থেকে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের দায়িত্বে অনেক পরিবর্তন এসেছে।

এক সময় মনে করা হতো শিক্ষক হবেন গুরুগম্ভীর ও জালালী মেজাজের, তার সাথে শিক্ষার্থীদের অবাধ মেলামেশা সমীচীন নয়। পক্ষান্তরে অধুনাকালে শিক্ষককে মনে করা হয়, শিক্ষার্থী ও সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু। তাই শিক্ষককে দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থেকে শিক্ষার্থীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানদানে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।

শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না থেকে সুশিক্ষক হওয়া যায় না। সুশিক্ষক হতে হলে শিক্ষক তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থেকে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিসত্তা গঠনে সহযোগিতা করবেন এবং তাঁর আচরণ ও চিন্তাধারা দ্বারা শিক্ষার্থীকে প্রভাবিত করবেন।

শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব এমনভাবে সংগঠিত হবে, যাতে করে তিনি স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থীদের মন আকর্ষণ করতে পারেন। শিক্ষার্থীদের সাথে তিনি সার্থকভাবে অভিযোজন করতে পারবেন, সে রকম ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সম্পর্কে বলেছেন :

“আমাদের সমাজব্যবস্থায় আমরা সেই গুরুকে খুঁজিতেছি যিনি আমাদের জীবনকে গতিবান করিবেন; আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা সেই গুরুকে খুঁজিতেছি যিনি আমাদের চিত্তের গতিপথকে বাধামুক্ত করিবেন”। (প্রাগ্রক্ত, পৃ. ২৮৯)

সেবার মনোবৃত্তি
বলা হয় Teaching is a noble profession অর্থাৎ শিক্ষকতা হলো মহান বৃত্তি। এ ধরণের আদর্শিক বৃত্তির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সৌভাগ্য সকলের হয় না। যার জীবনে এ বৃত্তির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার সুযোগ এসেছে তাকে শেখার মনোবৃত্তি নিয়ে পাঠদান করতে হবে। এখানে চাওয়া পাওয়া কিংবা স্বার্থের বিনিময়ে বিদ্যাদান কাম্য নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষকের এরূপ আদর্শকে বড় করে দেখছেন।

তিনি বলেছেন :
একদিন বুদ্ধদেব বলেছিলেন- ‘আমি সমস্ত মানুষের দু:খকে দূর করিব; দু:খ তিনি সত্যি দূর করতে পেরেছিলেন কিনা সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে তিনি এটি ইচ্ছা করেছিলেন, সমস্ত জীবের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন।” (প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮২)

মাদাম মন্তেস্বরী শিক্ষাক্ষেত্রে একটি অবিস্মরণীয় নাম। তার জীবনের মূল লক্ষ্য ছিলো সেবামূলক মনোভাবাপন্ন লোক তৈরি করা। সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে সারাজীবন শিক্ষাপদ্ধতির সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন।

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষের অজ্ঞতাই তার জীবনের সবরকমের বিপর্যয়ের কারণ। তাই এর উত্তরণ ঘটাতে হলে প্রকৃত শিক্ষায় দক্ষ শিক্ষকের সেবামূলক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে হবে। আর এর জন্য সর্বাগ্রে শিক্ষকের জ্ঞানদক্ষতার উন্নয়নের প্রয়োজন পড়বে।

পেশাগত প্রশিক্ষণ
শিক্ষণের পেশাগত জ্ঞানদক্ষতা উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণই হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির সর্বজনীন স্বীকৃত পদ্ধতি। বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকেই শিক্ষাব্যবস্থার মৌল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের পর বারবার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো অপরিহার্য। কেননা প্রশিক্ষণ ব্যতীত কোন শিক্ষকই চলমান পৃথিবীর নবতর চিন্তাধারার সাথে একাত্ম হওয়ার এবং সা¤প্রতিক ভাবধারার সাথে উজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ লাভ করতে পারে না।

শিক্ষাবিদ বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন : “প্রত্যেক শিক্ষককে প্রতি সাত বছরে এক বছর ছুটি দেয়া উচিত, যাতে তিনি অন্যান্য দেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন”। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১২)

শিক্ষকের প্রশিক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে শিক্ষাবিদ মার্গারেট বলেছেন, শিক্ষকের অনবরতই প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর ভাষায় শিক্ষকের অবিরাম প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। (স্কুল আরো ভালো কীভাবে করা যায়, পৃ. ২৩৫)

দক্ষতা অর্জনের পরিকল্পনা
শিক্ষকতায় দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনার গুরুত্ব সমধিক। ব্যক্তি কী ধরণের দক্ষতা অর্জন করতে চায় তা তার পরিকল্পনায় না থাকলে সাফল্যের চূড়ান্ত লক্ষ্য স্পর্শ করা যায় না। শিক্ষকতা পেশায় অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, অন্য কোন চাকুরি না হওয়ায় আপাতত এ পেশায় যোগ দিয়েছেন।

এতে বোঝা যায়, এমন ব্যক্তির দ্বারা শিক্ষকতা করা কিংবা শিক্ষকতা পেশায় দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব নয়। কেননা যার এ পেশার প্রতি আকর্ষণ নেই, পেশায় দক্ষতা অর্জনের জন্য কোন পরিকল্পনা নেই তার দ্বারা আর যা হোক শিক্ষকতার মত মহান ব্রতশীল পেশায় ভাল করা সম্ভব নয়।

কেননা এ পেশা এমন একটি পেশা যেখানে বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনার গুরুত্ব অনেক বেশি। বিশেষত যারা স্বেচ্ছায় এ পেশায় যোগদান করেন তাদের দীর্ঘ পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে সময়, অর্থ ও মেধার সঠিক মূল্যায়ন করে প্লানকে অর্থবহ করা প্রয়োজন।

কখনো যদি কোন প্লান যথাসময়ে যথার্থ মনে না হয় তখনো যেন আমরা হতাশায় না ভুগি। কেননা পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবভিত্তিক ছিল তা আমাদের জানা নেই। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা নেয়ার সময় নিজের মেধা ও ইচ্ছার সাথে সিনিয়র তথা অভিজ্ঞদের গঠনমূলক ইতিবাচক পরামর্শ যোগ করা যেতে পারে। কখনো অন্যের পথচলা পাথেয় হতে পারে।

মনে রাখতে হবে, শিক্ষক যত বড় পরিকল্পনা করুক না কেন, যত বড় জ্ঞানীর পরামর্শ গ্রহণ করুক না কেন নিজে যদি আন্তরিকতার সাথে তা বাস্তবায়ন না করেন তবে তা কখনোই সাফল্য হিসেবে ধরা দিবে না। কাজেই শিক্ষকের দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নত পরিকল্পনা প্রয়োজন। একটি ভাল কর্ম পরিকল্পনা তাকে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে নিয়ে যেতে পারে। এজন্য বলা হয় A Good Plan is 50% Achievement.

অজানাকে জানার স্পৃহা
শিক্ষক হচ্ছে তথ্য ও জ্ঞানের উৎস। তাই তাকে প্রতিনিয়ত অজানাকে জানার দূর্ণিবার স্পৃহা নিয়ে জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করতে হবে। নতুন নতুন তথ্য তার জ্ঞান ভান্ডারে সংযোজন করতে হবে। শিক্ষার্থী কর্তৃক উপস্থাপিত সকল বিষয়ে শিক্ষকের জ্ঞান নাও থাকতে পারে সেক্ষেত্রে কোনরূপ অস্পষ্টতার আশ্রয় না নিয়ে পরবর্তীতে জেনে বুঝে সমাধান দেয়া সমীচীন হবে।

তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে যেন শ্রেণী পাঠদান প্রক্রিয়া ব্যহত না হয়। আগামী প্রজন্মের চাহিদাকে সামনে রেখে শিক্ষককে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সকল বিষয় শিক্ষকের জানা থাকবে এটা নাও হতে পারে, তাই তাকে অজানা বিষয়কে জানার কৌশল আয়ত্ব করতে হবে।

আমরা জানি শিক্ষকের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, তদুপরি সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে দিয়ে অসীম জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে না পারলে নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণ করা যাবে না। আর নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে কাক্সিক্ষত পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন সুদূর পরাহত হবে-যা কারোরই কাম্য নয়।

নিয়মিত অধ্যয়ন
শিক্ষককে মনে করা হয় সকল জ্ঞানের আধার। তাই তাকে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। সীমিত জ্ঞান দ্বারা শিক্ষকতার মত বৃত্তিকে গ্রহণ করা যায় না। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা কৌতুহলী, তারা নানা প্রসঙ্গে তার জ্ঞানের পরীক্ষা নিবে, তাদের জ্ঞানপিপাসা তৃপ্ত করতে না পারলে শিক্ষকের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা হ্রাস পাবে। তাই শিক্ষককে জীবনব্যাপী শিক্ষার্থীর অভিপ্রায় নিয়ে নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক কখনো বিষয়ের বাইরেও অধ্যয়ন করতে হবে।

নিত্যনতুন বিষয় যেমন জানতে হবে, তদ্রুপ জানা বিষয়কে আবার জ্ঞানচর্চার নজরে আনতে হবে। শিক্ষকতা বা অধ্যাপনাকে অর্থোপার্জনের মাধ্যম না ভেবে জ্ঞানচর্চার সুযোগ ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমরা যেন শ্রেণীকক্ষে প্রবেশের আগে পূর্বপ্রস্তুতি নেই।

যত জানা বিষয়ই হোক তার পরও পাঠ্যবিষয়ের পূর্ব ধারণা নিয়ে পাঠদান করা প্রয়োজন। নতুন কোন কিছু সংযোজন করা যায় কী না তা চিন্তার জগতে নিয়ে আসতে হবে। সাথে সাথে যে বিষয়ের পাঠদান করা হবে সে বিষয়ের উচ্চতর কোন রেফারেন্স বই অধ্যয়ন করা হলো কী না সেদিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। বিশেষত বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উচ্চতর শ্রেণীর পাঠ্য কিংবা রেফারেন্স বই সংগ্রহে থাকা প্রয়োজন।

অনেক সময় বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা শুধু বইয়ের উপরই নির্ভরশীল নয়। এখন তথ্য প্রযুক্তির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। মিডিয়ার কল্যাণেও আমরা আমাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারি। যেসব পত্রিকা বিষয়ভিত্তিক ফিচার প্রকাশ করে তা শিক্ষকদের যেমন পড়া উচিত তেমনি সংগ্রহে রাখাও প্রয়োজন।

সেক্ষেত্রে বোধহয় শিক্ষকের সবচেয়ে ফলদায়ক তথা কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে ব্যক্তিগত পাঠাগার গড়ে তোলা। ব্যক্তিগত সংগ্রেহে বই থাকলে সময়ের যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক বই পড়া তার হবেই।

যিনি পড়াবেন তিনি বেশি পড়বেন এই নীতি গ্রহণ করে নিয়মিত অধ্যয়নের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষক যদি নিত্য নতুন তথ্য সরবরাহ করতে না পারেন কিংবা ঘটে যাওয়া সর্বশেষ সংবাদ না রাখেন তবে শিক্ষার্থীরাই একসময় তার প্রতি আকর্ষণ হারাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

প্রোক্ত বিষয়গুলো ছাড়া আরো যেসব বিষয়ে একজন শিক্ষক নজর দিবেন সেগুলো হচ্ছেÑশিক্ষকের স্ব- দক্ষতা; শিক্ষণ দক্ষতা; শিক্ষকের যোগ্যতা ও দক্ষতা; উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রজ্ঞা থাকা; সকল শিক্ষার্থীর সাফল্য কামনা; চিন্তাশীল হওয়া; অজানাকে জানতে স্বাচ্ছন্দবোধ করা; সহযোগিতা ও প্রভাব; শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ; পেশাগত জ্ঞানার্জন; পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন; শিক্ষার্থীর আচরণিক ভূমিকার উন্নয়ন; শিক্ষকের স্ব প্রতিফলন চেকলিস্ট; অর্জিত জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ; নির্ধারিত বিষয় ছাড়াও জ্ঞানার্জন করা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক জ্ঞানার্জন ইত্যাদি।

লেখক : ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান
অধ্যক্ষ, ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কলেজ, ধানমন্ডি, ঢাকা।
সভাপতি, বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতি।