আবুল কাশেম, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি : সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার প্রায় দুই শতাধিক দরিদ্র পরিবার কুমড়া বড়ি তৈরির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহসহ স্বাবলম্বী হয়েছে তারা। ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসা এখন গৃহস্থের বাড়ির আঙিনা ছাড়িয়ে বাণিজ্যিকভাবেও উৎপাদিত হচ্ছে। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে কুমড়া বড়ি তৈরির কাজ। অনন্য স্বাদের এ কুমড়া বড়ি তৈরি হয় ডাল আর কুমড়ার মিশ্রণে।
হরেক রকম ডাল দিয়ে এ বড়ি তৈরি হলেও অ্যাংকর ও মাসকলাই ডালের বড়ির চাহিদা একটু বেশি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহসহ বিদেশেও যাচ্ছে শাহজাদপুরের কুমড়া বড়ি। উপজেলার গাড়াদহ ইউনিয়নের তালগাছি গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার কুমড়া বড়ি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
এ ছাড়াও, উপজেলার পোরজনা, জামিরতা, ধীতপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম মিলিয়ে দুই শতাধিক পরিবার কুমড়ার বড়ি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ পরিবারগুলো শীত মৌসুমের পুরোটাই কুমড়া বড়ি উৎপাদন ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
বাড়ির নারীরাই মূলতঃ এ বড়ি তৈরির কাজ করে। আর পুরুষরা বাজারজাত করে থাকেন। এতে তারা মৌসুমে মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।
উপজেলার গাড়াদহ ইউনিয়নের তালগাছি গ্রামের কুমড়া বড়ি উৎপাদনকারী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। একটা সময় অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আগে সারাদিন ডাল ভিজিয়ে রেখে শিল-পাটা দিয়ে বেঁটে বড়ি তৈরি করতে হতো। এতে সময় লাগত অনেক বেশি। এখন শিল- বাটার বদলে ডাল মেশিন দিয়ে ভাঙানো হয়। এতে আমাদের খাটনি কমেছে ও সময় বেঁচে যাচ্ছে এবং এখন বেশি বড়িও তৈরি করতে পারছি।’
তালগাছি গ্রামের নুরুল ইসলাম জানান, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সাধারণত ডাল ভিজিয়ে মেশিনে গুঁড়া করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে বড় গামলা বা বালতিতে ডালের গুঁড়া, পাকা চালকুমড়া, কালোজিরা, গোলমরিচ এবং মসলা মিশিয়ে সুস্বাদু কুমড়া বড়ি তৈরি করা হয়। এরপর টিনের বা কাঠের পিঁড়িতে পামওয়েল তৈল মাখিয়ে কাপড়ের সাহায্যে জিলাপি তৈরির মতো বড়ি করে সাজিয়ে শুকাতে দেয়া হয়। ৩-৪ দিন কড়া রোদে শুকালে প্রস্তুত হয় সুস্বাদু কুমড়ার বড়ি। এ কাজগুলো নারীরাই করেন।
তারা আরো বলেন, শাহজাদপুরের উৎপাদিত কুমড়ার বড়ি স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে জেলা শহর হয়ে এখন রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের কাঁচাবাজারগুলোতে স্থান করে নিয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা শাহজাদপুরের তালগাছিতে আসেন কুমড়ার বড়ি কিনতে। পাইকারি দাম কিছুটা কম। এ ছাড়া অর্ডার দিয়ে বানালে খরচটা আরও বেশি পড়ে। তারা জানান, শিল-পাটায় বাটা ডালের তৈরি বড়ির কদর সবসময় একটু বেশি থাকে।
এদিকে আত্মীয়-স্বজনদের হাত ঘুরে কুমড়া বড়ি এখন প্রবাসী বাঙালিদেরও রসনা তৃপ্ত করছে। এ অঞ্চলের মানুষ যারা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছেন তাদের জন্য পাঠানো হচ্ছে এই বড়ি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাত ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিচিতি পাচ্ছে এ সুস্বাদু তরকারি।
কুমড়ার বড়ি উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন গড়ে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ কেজি ডালের বড়ি তৈরি করতে পারেন। বাড়ির দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে নারীদের পক্ষে এটা করা সম্ভব। কারণ, ভোর থেকে শুরু করে সকাল ৯টার মধ্যে বড়ি তৈরি বা রোদে দেয়ার কাজ শেষ হয়। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত কুমড়ার বড়ির ভালো ব্যবসা চলে।
এ মৌসুমে ব্যবসা করে সংসারে বাড়তি আয় করে বহু পরিবার দারিদ্র্য দূর করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ জীবিকা নির্বাহ করেন এই বড়ির ওপর ভিত্তি করে।
উপজেলার গাড়াদহ ইউনিয়নের তালগাছি গ্রামের নয়ন খাতুন (৪২), আঞ্জুয়ারা (৩২), মনজুয়ারা (৩৭), মজনু মিয়া (৩৮) সহ অর্ধ শতাধিক পরিবার এই কুমড়ার বড়ি তৈরি ও বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন।
স্থানীয়রা জানান, বড়ি তৈরিতে চাল কুমড়ার সঙ্গে ডালের যেমন নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তেমনি রান্নার সময় কুমড়ার বড়ির সঙ্গে মিঠাপানির মাছ থাকলে তা অনন্য হয়ে ওঠে। এই কুমড়ার বড়ি যেকোনো ঝোলের মাছের তরকারি হিসেবে ব্যবহার হয়। দেশি প্রজাতির কৈ, মাগুর, শিং, শৈল, আইড়, গজারসহ মাছের তরকারি রান্নায় স্বাদে বৈচিত্র আনতে ব্যবহার করা হয় এই কুমড়ার বড়ি। অনেকে নিরামিষ তৈরিতে ডাল মেশানো কুমড়া বড়ি ব্যবহার করে থাকেন।
স্থানীয়রা বলেন, ডাল ও মসলার দাম বেড়ে যাওয়ায় কুমড়া বড়ি তৈরিতে খরচ বেশি পড়ছে। ফলে হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তাই, স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি করেন তারা।