আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) : গ্রামীণ কুসংস্কার আর প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে নিজেকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত জোকা গ্রামের লিপি। কেবল সংসারের হাল টেনে ধরা মেয়ে কিংবা সফল স্ত্রী নন, তীব্র ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্র নিষ্ঠায় নিজ পরিচয়ে লিপি এখন ঢাকা বিভাগের অন্যতম সফল তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষক ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির কারিগড়।

করোনা কালীন দু:সময়ে প্রায় দুই বছর অচলাবস্থা, আর্থিক টানাপোড়েন আর জেলা শহরের মার্কেট ভেঙে ফেলার কারনে অনেকটা অসহায় হয়ে পরেন লিপি। তবে হতাশা কাটিয়ে নতুন উদ্যোমে শুরু করেছেন লিপি, এবার জেলা শহর থেকে রাজধানীতে। ঢাকার মিরপুরে শুরু করেছেন কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার।

করোনাকালীন সময়ে অনলাইনেও নিয়েছেন কম্পিউটার ক্লাস। তবে আর্থিক ক্ষতিটা অনেক হয়ে গেছে। দোকান ভাড়া, সংসার, বিদুৎ বিলসহ আনুসাঙ্গিক খরচে ধার দেনাও করতে হয়েছে তাকে, বললেন লিপি।

ফারহানা আফরোজ লিপি বলেন, এসএসসি পাশ করে সবেমাত্র কলেজে পা রেখেছি। পরিবারের সবার সঙ্গে উচ্ছাস-আনন্দেই কাটছিল দিন। কিন্তু ৬ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা মোঃ আনোয়ার হোসেন হঠাৎ একদিন মারা গেলেন। অস্বচ্ছলতা ও হতাশা নেমে এলো পরিবারে। অর্থকষ্টে দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্য যোগানই সেসময় পরিনত হলো অনিয়মিত রুটিনে। তখন লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া দুরূহ বিষয় হয়ে দাড়াল। হাল ছাড়িনি।

লিপির মা রোকেয়া আনোয়ার বলেন, দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে লিপি সেজ। ওর বাবার জমানো সামান্য কিছু টাকা দিয়ে বড় মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ওর বাবা মারা যায়। অন্ধকার নেমে আসে আমাদের জীবনে। লিপি প্রাইভেট পড়িয়ে কোন রকমে চালিয়ে যায় নিজের পড়াশোনা। কিন্তু সংসার আর ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চলবে কিভাবে? তখন লিপি গ্রামের আর দশজন গৃহবধূদের দিয়ে জামা/পাঞ্জাবী সেলাইয়ের কাজ করিয়ে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) জমা দিতেন।

২০০৩ সালের কথা। একদিন মানিকগঞ্জ পৌর সুপার মার্কেটে বিট-বাইট কম্পিউটার সেন্টারে কম্পিউটার শেখার আগ্রহের কথা জানালেন লিপি এবং খুলে বললেন তার জীবনের সব ঘটনা। সবকিছু জানার পর টাকা ছাড়াই কম্পিউটার শেখানোর প্রতিশ্রুতি পেয়ে পরের দিন থেকেই শুরু করলেন প্রশিক্ষণ নেওয়া। এক সঙ্গেই চলতে থাকল সেলাই কাজ আর কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। এভাবে ছয় মাস না যেতেই মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, ফটোশপসহ কম্পিউটারের আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামিং সফটওয়্যারের কাজ সম্পর্কে ভালো ধারণা হলো তার।

এক সময় লিপির সুযোগ হলো প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি এই সেন্টারের প্রশিক্ষক হওয়ার। পারিশ্রমীক হিসেবে মাসে দুই হাজার টাকা। ফলে বাদ দিলেন সেলাইয়ের কাজ। আরও মাস ছয়েক পার হবার পর বেতন বৃদ্ধি পেয়ে দাড়াল তিন হাজার টাকায়। এভাবে প্রশিক্ষনের চাকুরী কেটে গেল কয়েক বছর।

এবার লিপির মনে ভাবনার উদয় হলো, নিজেই একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দিলে কেমন হয়? ২০০৯ সালের মার্চ মাসের কথা। শেষমেশ তিনি মাসে এক হাজার টাকা ভাড়ায় একটি দোকানের ব্যবস্থা করলেন। একটি কম্পিউটার নিয়ে শুরু হলো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কার্যক্রম। দুজন প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি করা হলো। শুরু হলো লিপির নতুন করে স্বপ্ন দেখার, নতুন করে বাঁচার।

প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির নাম দিলেন ’লিপি কাম্পউটার সেন্টার’। মার্কেটের আশপাশের ব্যবসায়ীরা বিষয়টি খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না। এতে সে বিচলিত না হয়ে নয়া উদ্যোমে মনোনিবেশ করলেন কাজে। দিন দিন বাড়তে থাকলো প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা। পড়ালেখা ছাড়েননি তিনি। মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ফেললেন। মাঝে বিয়েও করেন। বিয়ের পর থেকে তাঁকে সব সময় সহযোগীতা করছেন স্বামী রকিবুল হাসান পাভেল। লিপির ট্রেনিং সেন্টারের দেখাশোনাও করেন পাভেল।

বর্তমানে তাঁর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১৫টি কম্পিউটার, রয়েছে ১শ’র ওপরে প্রশিক্ষণার্থী। মার্কেটের ব্যবসায়ীরা সবাই এখন তাঁকে সম্মান করেন। ডাকেন “কম্পিউটার আপা” বলে।

তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় সহস্রাধীক নারী-পুরুষ বিভিন্ন পেশায় কম্পিউটার বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১১ সালে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ইনষ্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ভবনে ’ওয়াল্ড আইসিটি গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

ঢাকা বিভাগের শতাধিক অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বিশেষ অবদানের কারণে লিপি কম্পিউটার সেন্টার প্রথম হওয়ায় ওই অনুষ্ঠানে তাঁকে স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।

২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি ফাউন্ডেশন ‘আইসিটি শ্রেষ্ঠ উদ্যেক্তা’র সম্মাননা স্মারক হিসেবে ক্রেষ্ট ও স্বর্ণপদক প্রদান করা হয় তাঁকে।

ফারহানা আফরোজ লিপি বললেন, আমি সব সময় হৃদয়ে ধারন করি “সাফল্য তাদের কাছেই ধরা দেয় যারা সাহস করে এগিয়ে যায়”। বাংলাদেশের নারী সমাজ দীর্ঘকাল থেকেই নানানভাবে বঞ্চিত। জীবনে বাধা-বিপত্তি আর ঘাত-প্রতিঘাত আসতেই পারে। তবে সেই ঘাত-প্রতিঘাত উপক্ষো করে এগিয়ে চলার নামই জীবন।