এম. মনিরুজ্জামান, রাজবাড়ী প্রতিনিধি : রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের রামদিয়া গ্রামে কমলা চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন স্কুল শিক্ষক আব্দুস সালাম ও তার ভাই আব্দুল রউফ। প্রথমবারের মতো তার বাগানের দেড় শতাধিক গাছে থোকায় থোকায় কমলা ধরেছে। এরই মাঝে বাগান থেকে কমলা তোলা শুরু করেছেন তারা। কমলার আকার বড় এবং সুস্বাদ ও মিষ্টি। এই বাগান দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছে সাধারণ মানুষ। আবার সমতল ভূমিতে কমলা চাষে সাফল্য পাওয়ায় কমলা চাষে দেখতে আসছেন পাশ্ববর্তী উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষকেরা। ভালো ফলনে লাভজনক হওয়ার কারণে কমলা চাষে উদ্যোগ নিচ্ছেন অনেক কৃষক।

আব্দুস সালাম ও আব্দুর রউফের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, ১৮৩টি গাছে থোকায় থোকায় কমলা ধরে আছে। বেশির ভাগ কমলা পেকে হলুদ হয়ে গেছে। আবার বেশ কিছু কমলা সবুজ রয়েছে। তাদের ভাগ্নে জাহিদুল ইসলাম বাগান পরিচর্যা করছেন। তিনি জানান, তার মামা আব্দুস সালাম অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। ক্লাস শেষে বাগানে আসেন কমলা চাষি আব্দুল সালাম।

আব্দুস সালাম বলেন, আমার জানা ছিলো কমলা সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে হয়ে থাকে। তবে মাথায় ঘুরপাক খেতো সমতল ভূমিতে কমলা চাষ সম্ভব সেই ধারণা থেকে ২০১৫ সালে কমলা চাষ শুরু করি। এক একর জমিতে ১৮৩টি মেরিন্ডা জাতের কমলা চাষ শুরু করি। দেড় বছর পরে ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে কমলা গাছে ফুল আসে। নয় মাসের মাথায় কমলা পাকতে শুরু করে। প্রতিটি গাছে ৫০ কেজি করে কমলা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কমলা গুলোর স্বাদ বেশ মিষ্টি হয়েছে। এরই মাঝে বাগান থেকে কমলা বিক্রি শুরু করেছেন বলে জানান তিনি।

ছাত্রজীবন থেকেই তার মনের মধ্যে ইচ্ছা নার্সারি করার। পরে কর্মজীবনে প্রবেশ করেই রামদিয়া বিএমবিসি উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক আবদুস সালাম শেখ তার বড় ভাই ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুর রউফ শেখের সার্বিক সহযোগিতায় গড়ে তুলেছেন স্বপ্ন চূড়া নার্সারি অ্যান্ড এগ্রো ট্যুরিজম। তারা দু’জন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের কাউন্নাইর গ্রামের মরহুম ঘুড়ান শেখের ছেলে।

স্কুল শিক্ষক আবদুস সালাম শেখ জানান, তার বাবার স্বপ্ন ছিল এডভান্স কৃষি খামার গড়ে তোলা। সে লক্ষ্য নিয়েই বাবার স্বপ্ন পূরণে রামদিয়া বিএমবিসি উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে তার বসতবাড়ি এখন ‘স্বপ্ন চূড়া নার্সারি অ্যান্ড এগ্রো ট্যুরিজম’। এর মধ্যে এক একর জায়গায় কমলা চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি এ বছর বাগানের উৎপাদিত কমলা জনগণের সেবায় উৎসর্গ করেছেন। এ ছাড়াও পাঁচ একর জমি লিজ নিয়ে এক একর জমিতে থাই পেয়ারা, ৪২ শতাংশ জমিতে মাল্টা, সাড়ে তিন একর জমিতে নার্সারি গড়ে তুলেছেন। গত বছর এ নার্সারি থেকে ১৮ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন। চারা বিক্রির সমুদয় টাকাই লেবার খরচ ও জমি লিজে ব্যয় হয়েছে। এ বছর ৫০ লাখ টাকার চারা বিক্রির টার্গেট রয়েছে। এই নার্সারিতে ব্যানানা ম্যাংগো, কিউজুয়াই, থাই বারোমাসি, গৌরমতি, কিং অফ চাকাপাত, নারিকেল কেরালা, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, শরিফা বারোমাসি সাদা ও লাল, জাম্বুরা থাই সাদা ও লাল, বারোমাসি কাঁঠাল, বারোমাসি কদবেল, কাশ্মিরি বরই, বল সুন্দরী, সিডলেছ, বারোমাসি চায়না লেবু, থাই বারোমাসি লেবু, সিড লেছ কাটাবিহীন লেবু। উন্নত জাতের দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন ফলদ ও ফুলের নার্সারি গড়ে তুলেছেন।

তিনি আরো বলেন, আমাদের সিলেট অঞ্চল ও বিদেশ থেকে কমলা আমদানি করতে হয়। আমার এ উদ্যোগ বিভিন্ন অঞ্চলে কমলা চাষের সম্প্রসারণ ঘটানো। এতে কমলা আমদানি করতে হবে না। বরং রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। আমার এ উদ্যোগে বেকার সমস্যার সমাধান ও তরুণ প্রজন্ম এ নার্সারি দেখে চাষে আগ্রহী হবে। কমলার বাগান দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন অসংখ্য দর্শনার্থী। আব্দুস সালাম ও আব্দুর রউফের কমলা চাষ দেখতে প্রতিদিন নিজ এলাকা ছাড়া আশেপাশের এলাকার রামদিয়ার কমলা বাগানে আসছেন। অনেকেই কমলা চাষের পদ্ধতি শিখে কমলা চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

প্রতিবেদন করার সময় বেশ কয়েকজন কৃষক তার বাগান দেখতে আসেন। প্রতিদিন ১০-১৫ জন কৃষক তার কমলা বাগান দেখতে আসছেন।

বালিয়াকান্দির নবাবপুর ইউনিয়ন আনন্দ বাজার থেকে আসা আব্দুল কাদের বলেন, আমি জানতাম কমলা চাষ সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে হয়। কিন্তু বালিয়াকান্দিতে কমলা চাষ হয় সেটা জানা ছিলো না। ফেসবুকে ছবি দেখে আজ নিজে দেখতে আসলাম। কমলাচাষিদের কথা শুনে মনে হয়েছে এটি বেশ লাভজনক। আশা করছি আগামীতে আমার বাড়ীর পাশের এক বিঘা জমিতে কমলা চাষ শুরু করবো।

বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আম্বিয়া সুলতানা বলেন, বালিয়াকান্দির মতো জায়গায় কমলা চাষ এই অঞ্চলের কৃষিকে আরো সমৃদ্ধ করবে। কৃষি বিভাগের সাথে পরামর্শ করে কমলা চাষ উপজেলার অনান্য জমিতে করা যায় কিনা সেটি নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিষয়টি জেলার উন্নয়ন সমন্বয় সভায় উপস্থাপন করা হবে। সবারই এ ধরনের ব্যতিক্রমী চাষে এগিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোলাপ কৃষ্ণ দাস বলেন, সমতল ভূমিতে কমলা চাষ সম্ভব। তবে বালিয়াকান্দিতে উৎপাদিত ম্যারিন্ডা জাতের কমলার মিষ্টিত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে। রাজবাড়ীর মাটি ক্যালক্যারিয়া গ্রুপের হলে মিষ্টি ও মানসম্মত ভাল কমলা উৎপন্ন হবে। আমরা শুধু বালিয়াকান্দিতেই নয় রাজবাড়ীর উপজেলাতে কমলা চাষ ছড়িয়ে দিতে উন্নত মানের চারার সন্ধান করছি। রাজবাড়ীতে কমলা চাষ সম্ভব হলে রাজবাড়ীর কৃষি আরো সমৃদ্ধ হবে।