এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) : রূপ, রং আর ঋতু বৈচিত্রের দেশ বাংলাদেশ। সষ্যের শ্যামলতা ভাটিয়ালী সুরের গান, রাখালের বাঁশি, কৃষাণের উদার জমিন, কৃষাণীর ধান ভানার উল্লাস, ছয় রূপের ছয়টি ঋতু সব মিলিয়ে এ যেন কোন শিল্পীর নিপুণ হাতে রং তুলিতে আঁকা স্বপ্নের দেশ। এদেশে সন্ধ্যে-সকালে ডাহুক, দোয়েল, কোয়েলের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। প্রকৃতির পালা বদলে আসে ছয়টি ঋতু। ঋতু চক্রের ঘূণয়মান রূপকালে এখন হেমন্তকাল। কৃষকের সবুজ শ্যামল ধানের ক্ষেত সোনা রং ধারণ করছে।
পাকা ধানের মৌ-মৌ গন্ধে বাতাস ভরে উঠেছে। মাঠে-মাঠে, ঘরে-ঘরে চলছে ধান কাটার উৎসব। দিনেতো হাজারো ব্যস্ততা আছেই তার উপর রাতভর চলে ধান মাড়াইয়ের কাজ। এত ব্যস্ততার পরেও কৃষক তার কৃষাণ বধূ মহা খুশি। ধান নিয়ো গোলা ভরে আনছে মেতে উঠে নবান্নে উৎসবে। নতুন চালের ভাত, পিঠা-পুলি, আর পায়েসের গন্ধ ভেসে আসে প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে। তবে আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে অপার আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে আমাদের কৃষিক্ষেত্রে। ধান বোপন, রোপন, ধান কাটা, মাড়াই করা এমনকি ধান তেকে চার করা নিয়ে প্রত্যেকটা কাজই সম্পন্ন বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার দ্বারা। গরু আর লাঙ্গল টানা সেই জরার্জীণ কৃষককে এখন আর দেখা যায় না। হালের গরু ছেড়ে কৃষক এখন সাহায্য নেয় ট্রাক্টারের। পাঁচ মিনিটেই জমি প্রস্তুত। বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। পাম্পের সাহায্যে সেচ কাজ করে পানির চাহিদা মিটানো হচ্ছে। প্রতিনিয়তই নিত্য নতুন সব কীটনাশক বাজারে আসছে। এখন আর কৃষককে রৌদ বৃষ্টিতে ভিজে ধানের বীজ তার শষ্যক্ষেতে ছিটিয়ে দিতে হয় না। জমিতে বীজ ছিটানোর জন্যে এখন আছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। ধানের পাতা পরীক্ষা করে এ জমির উপযোগী কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। ধানের আগাছা পরিষ্কার করার জন্যেও ব্যবহার হচ্ছে এক ধরনের দাঁতালো যন্ত্র। ধান কাটার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে ধান কাটার যন্ত্র। দিনব্যাপি চাষাকে আর গায়ের ঘাম ঝরিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে না।
ধান কেটেই কি শেষ, ধানতো ঘরে তুলতে হবে। মাড়াই করতে হবে। আগে গাঁয়ের বৌ-ঝিরা পিটিয়ে, পা দিয়ে মাড়িয়ে ধান নিত। কিন্তু এখন সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে সেই পিটিয়ে বা পা দিয়ে মাড়িয়ে ধান নেয়া অনেকাংশেই কমে এসেছে। এখন হরেক রকমের ধান মাড়াইয়ের যন্ত্র বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দিয়ে আসছে। কাজ কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। আরো কিছুটা ব্যস্ততা এখনো আছে। ধান থেকে তো চাল করতে হবে। তো চাল টাকি মায়েরা, চাচীরা রাত জেগে ঢেঁকিতে দুলে দুলে করবে? মোটেইনা ধান থেকে চাল করার জন্যে মেশিন তো আমার ঘরের সামনেই হাজির। তাহলে আর এত কষ্ট কিসের ? আর তাছাড়া শষ্য রোপন থেকে শুরু করে মাড়াই পর্যন্ত সবকিছুই করা যায় শষ্যের জমিতে। বিজ্ঞান এবং আধুনিকতা এই দুইয়ে মিলে আমাদের কৃষি কাজে এনে দিয়েছে আমূল পরিবর্তন। তবে এটাও ঠিক বিজ্ঞানের এই নব নব আবিষ্কারের ভিড়ে আমরা হারাতে বসেছি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে, আমাদের স্বকিয়তাকে, আমাদের সত্ত্বা। আর এই বৈজ্ঞানীক যন্ত্রপাতির প্রত্যেকটিই খুবই ব্যয়বহুল। আর আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই দরিদ্র সীমার নীচে বাস করে। তারা এখনো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের অন্ন যোগান দেয়। তবে আস্তে আস্তে সবই আমাদের করায়ত্ব হবে। বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে করেছে সহজ, সাবলীল আর অর্থনীতির চাকাকে করেছে সমৃদ্ধ।
উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ মঘাদিয়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায় কয়েকটি পরিবারে এখনো গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছে। নারীরাও পা দিয়ে ধান মাড়াই করছেন। কথা হয় এনামুল হকের সাথে। তিনি বলেন, আগে প্রতি ঘরে ঘরে গরু দিয়ে ধান মাড়াই হতো। এখনো মেশিন দিয়ে ধান মাড়াই হয়। এতে ব্যয় একটু বেশি হলেও সময় বাঁচে। গরু দিয়ে ধান মাড়ানো সম্পর্কে তিনি বলেন, ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা হয়।