তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, সুনামগঞ্জ : মহান মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাসের সাক্ষী সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলা (হক নগর) বিজয়ের মাসের শুরু থেকেই এখানে দর্শনার্থীদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর ডিসেম্বর এলেই অনেক লোকজনের সমাগম ঘটে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এই এলাকায়। ঐতিহাসিক ‘হক নগর’ সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্তের জিরো পয়েন্ট এলাকায় অবস্থিত।
মেঘালয়ের পাদদেশে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা এই স্থানে রয়েছে ‘হকনগর’ শহীদ স্মৃতিসৌধ। কয়েক বছর পূর্বেই জেলার পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষনার পর ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে বাঁশতলা (হক নগর)। এখানকার প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন উৎসাহী পর্যটকরা।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সরজমিনে গিয়ে দেখা গেলো, বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য নারী-পূরুষ জড়ো হয়েছেন ‘হক নগর’ এলাকায়। নজরকাড়া মনোরম দৃশ্যের পাহাড়ের পাদদেশে অনেকেই ছবি তুলতে ব্যস্থ রয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় গৌরবোজ্জল স্থানটি একনজর দেখতে ছুটে এসেছেন রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা চাকুরীজীবী কলিম উদ্দিন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে।
মূলত তিনি বেড়াতে এসেছিলেন সিলেট নগরীতে। স্থানীয় একজনের কাছে ঐতিহাসিক হক নগরের গল্প শুনে শহীদ স্মৃতিসৌধ ঘুরে দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।
তিনি বলেন, ছাতক থেকে সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে সড়ক পথে হক নগর এসেছেন তিনি। তবে নোয়ারাই বাজার থেকে বাঁশতলা এলাকা পর্যন্ত সড়কের বেশ কিছু এলাকায় ভাঙ্গা-চোরা হওয়া অনেক কষ্ট হয়েছে গন্তব্যে পৌছতে।
এলাকার চারদিকে শুধু সবুজের হাতছানি। শেষ বিকেলে পাখির কলকাকলী ও মিষ্টি রোদে মৃদু বাতাস প্রাণ জুড়িয়ে দিয়েছে। এখানকার ছোট টিলা-পাহাড়ে সাজানো নজরকাড়া দৃশ্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পাহাড়ি ঝরনা চোখে পড়ার মতো। মৌলা নদীর ওপর স্লুইচগেট দেখতে অনেকটা জলপ্রবাহের মতোই। পাহাড়ি ঝরনার পাশে স্লুইচগেট আলাদা সৌন্দর্য্যরে সৃষ্টি করেছে। তার মতো অনেকেই এখানে আসেন বেড়াতে।
ভারতীয় সীমানার কোলঘেঁষা বাংলাদেশের জুমগাঁও গারো পাহাড়ের ২৬টি পরিবারের বসবাস। পাহাড়ি এই গ্রামে আদিবাসী গারো স¤প্রদায়ের লোকজনও এখানে আগত পর্যটকদের স্বাগত জানায়। এখনাকার পরিবেশ অনেকটাই শান্ত ও মনোরম। এলাকার সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশ যেন মিতালী পেতেছে। পাহাড়ের সমতলেই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। হক নগর এলাকার চারদিকে সবুজের সমারোহ। পড়ন্ত বিকেলে পাখির কলরব এবং বাতাসের মন মাতানো শব্দে প্রাণ জুড়ায়। ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়ে সাজানো বিস্তীর্ণ এলাকা যেন মন ছুঁয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, (হক নগর) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ৫নং সেক্টরের চেলা (বাঁশতলা) সাব-সেক্টর সদর দফতর ছিলো। এই সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন এএস হেলাল উদ্দিন। পরবর্তী সময়ে ছিলেন লে. আব্দুর রউফ ও লে. মাহবুব। সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনায় ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করেন মরহুম এমএন আব্দুল হকসহ আরো অনেকেই।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ডাকে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে এমএনএ হক, ডাঃ হারিছ আলী, হেমেন্দ্র দাস পুরকায়স্থ, ডাঃ আব্দুল মছব্বির (বাঁশতলা) হাজী মফিজ আলী (বড়খাল), সামছুল হক চেয়ারম্যান (বাংলাবাজার), ডাঃ আহসান উল্লাহ (ভাঙ্গাপাড়া), ডাঃ আব্দুল হামিদ (টেংরাটিলা) মদন মোহন নন্দী (হাসাউড়া), আব্দুল কাদের মেম্বার (কান্দাগাঁও) সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বাঁশতলা সীমান্তে সমবেত হয়ে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাঁশতলাসহ এর নিকটবর্তী আশাপাশ এলাকায় যারা শহীদ হয়েছেন তাদের এখানেই দাফন করা হয়।
চেলা (বাঁশতলা) সাব-সেক্টরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী, আব্দুল হালিম ও আব্দুল মজিদ ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছাতকের এমএনএ আব্দুল হক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন ৫ নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধে এলাকায় তার বিশেষ অবদানের জন্যে পরবর্তীতে তার নামানুসারে গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘হকনগর’। মরহুম আব্দুল হকের নাম দিয়েই হকনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হকনগর গ্রাম ও হকনগর স্মৃতিসৌধসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম করন করা হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মরহুম সামছু মিয়া চৌধুরী এমপির উদ্যোগে এখানকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর পাকা করন করা হয়। দু’বছর পূর্বে মুক্তিযুদ্ধে ৫নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা, জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল হকের কবরটি ছাতক শহর থেকে তুলে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাঁশতলা-হকনগর শহিদ স্মৃতিসৌধে স্থানান্তরিত করা হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাঁশতলার মাঠে তাবু করে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পরই তিনি এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।