# অবদান রাখছে রাখছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে
# স্বাবলম্বী হচ্ছেন প্রান্তিক নারীরা
# গ্রীষ্মকালে এসব পাটির কদর বেশি
এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) : ঘড়ির কাঁটা সকাল ৭ টা ছুঁই ছুঁই। মিরসরাই-সীতাকুন্ড উপজেলার প্রাচীন বাজার বড়দারোগাহাটে বসেছে শীতল পাটির বাজার। উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিক্রি করতে পাটি নিয়ে এখানে ছুটে এসেছেন অর্ধশত মানুষ। তাদের মধ্যে পুরুষের পাশাপাশি ১২-১৫ জন নারীও রয়েছে। সকাল নয়টা বাজতেই শোরগোল শেষ। পাটি বেচা-কেনা শেষ। সপ্তাহের প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার এখান থেকে পাটি ক্রয় করতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী সহ বিভিন্ন এলাকায় পাইকাররা ছুটে আসেন। এই হলো বড়দারোগাহাট বাজারের চিত্র। এভাবে উপজেলার আরো প্রায় ৮টি বাজারে বসে পাটির বাজার।
জানা গেছে, উপজেলার ৮টি বাজারে অর্ধকোটি টাকার শীতল পাটি বিক্রি করা হয়। উপজেলার মিঠাছড়া, বড় দারোগাহাট, শান্তিরহাট, আবুরহাট, বারইয়ারহাট, জোরারগঞ্জ ও আবুতোরাব বাজারে শীতল পাটির ব্যতিক্রমি বাজার রয়েছে। এসব বাজারে সপ্তাহে দুই দিন বাজার বসে। লেনদেন হয় প্রায় অর্ধকোটি টাকা। ভোর ৬ টায় শুরু হয়ে সকাল ৯টার আগে বিকিকিনি শেষ হয়ে যায়।
উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার প্রায় প্রতিটি গ্রামের শীতল পাটি তৈরি হয়ে থাকে। গ্রামের নারীরা দৈনন্দিন কাজে ফাঁকে ফাঁকে শীতল পাটি বুনে থাকেন। আর গ্রামীণ নারীদের বুনা এসব পাটি বিক্রয়ের নির্ভরযোগ্য বাজারগুলোতে শীতল পাটির হাট বসে খুব ভোরে।
উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের নারী পুরুষ তাদের বুনা শীতল পাটি নিয়ে বিক্রয়ের জন্য হাজির হয় এসব বাজারে। পাইকারি পাটি ক্রেতারা হাটের আগের দিন এসে বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অবস্থান নেয়। গ্রীষ্মকালে এসব পাটির কদর বেশি থাকে। তবে নকশা করা শীতল পাটির কদর শহরে খুব বেশি।
এখানকার নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীদের অন্যতম পেশা শীতল পাটি বোনা। এর কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয় পাটিপাতা বা পাটিবেত। সবুজ রঙের এই উদ্ভিদের বড় বাজার বসে উপজেলার বামনসুন্দর দারোগারহাটে। সেখান থেকে পাটিপাতা সংগ্রহ করে পানিতে ভিজিয়ে, আবরণ ছাড়িয়ে তোলা হয় দুই রকমের বেত। তারপর রঙ দিয়ে রাঙানো হয়। এরপর শুরু হয় পাটি বোনা। শিল্পীর নিপুন হাতে শীতল পাটিতে ফুটে ওঠে গাছ-গাছালি, পাখি, মসজিদ, হরিণ, বাঘ, ফুল, হাতি, ঘোড়া আবার কখনো বা বাংলাদেশের মানচিত্র।
উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মধ্যম ওয়াহেদপুর গ্রামের পাটি বিক্রেতা রোকেয়া বেগম জানান, সপ্তাহে দুইটি পাটি বুনা যায়। আগে পাটির তৈরির উপকরণ বেত সব সময় পাওয়া যেত । কিন্তু এখন বেত হারিয়ে যাচ্ছে। তাই পাটি তৈরিতে এখন খরচ বেশি হয়। প্রতিটি পাটি আকার ভেদে ৯শত টাকা থেকে ৩ হাজার ৫শত টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। তবে পাইকারী বিক্রি করায় গ্রামীন নারীরা বেশি দাম পায় না। একাধিক হাত ঘুরে এসব পাটি দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় পৌছে যায়।
সাইফুল মিয়া নামে আরেক এক পাটি বিক্রেতা জানান, সপ্তাহে দুইটি পাটি তৈরি করা সম্ভব হয়। তবে জনবল বেশি থাকলে আরো বেশি পাটি তৈরি করা সম্ভব ।
একাধিক পাটি বিক্রেতা জানান, খুব ভোরে বিকিকিনি শুরু হওয়ায় পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের আসতে একটু অসুবিধা হয়ে থাকে।
জানা গেছে, শীতল পাটি গ্রীস্মের প্রচন্ড গরমে চোখ বুজে একটু শান্তিতে ঘুমানোর জন্য আরামদায়ক বলে যুগ যুগ ধরে গ্রামবাংলায় শীতল পাটির কদর। গ্রীস্মের প্রচন্ড তাপে অতিষ্ট প্রাণীকুল আর তার সাথে আধুনিক প্রযুক্তির সভ্যতার বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের মধ্যে মানুষ যেন অসহায়। আর এ জন্যই একটু শীতলতার পরশ পেতে মানুষ যেন কৌশলী রুপে তৈরি করে আসছে শীতলপাটি।
মিরসরাই উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে কম বেশী বিক্রয় অথবা নিজ প্রয়োজনে শীতলপাটি বুনতে দেখা যায়। শীতল পাটি বুনে সংসাদের স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীও সচ্ছলতা আনেন। আর গ্রীষ্মকাল এলেই বেড়ে যায় শীতল পাটি বুনার কাজ। কারণ গ্রামের কুঁড়ে ঘর থেকে শহরের দালান কোঠা পর্যন্ত শীতল পাটির ব্যবহার রয়েছে। মিরসরাইয়ে সবচেয়ে বেশী শীতলপাটি তৈরি হয় উপজেলার ইছাখালী, বামনসুন্দর, কাটাছড়া, নাহেরপুর, ইসলামপুর, মিঠাছড়া এলাকায়।
অপূর্ব নির্মাণ শৈলী আর রঙ-বেরঙের পাটি নিয়ে হাজির হন তারা। যে পাটির নির্মাণ ও নকশা শৈলী যত সুন্দর সে পাটির দামও তত বেশি।
ফেনী থেকে পাইকারীভাবে পাটি ক্রয় করতে আসা ব্যবসায়ী এমরান হোসেন বলেন, মিরসরাইয়ের শীতল পাটির চাহিদা অন্য এলাকা থেকে একটু বেশি। কারণ এখানকার পাটির আলাদা কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে। বিশেষ করে নির্মাণশৈলি অনেক টেকশই।
মিঠাছরা বাজারে গিয়ে কথা হয় পাটি শিল্পী জোবেদা বেগমের সাথে। তার বাড়ি উপজেলার পূর্ব দুর্গাপুর গ্রামে। তিনি ২ হাজার ২০০ টাকায় দুইটি শীতল পাটি বিক্রি করেছেন। তিনি জানান, ‘দুধারি’ একটি শীতল পাটি বুনতে একজন নারীর কমপক্ষে ৬ দিন সময় লাগে। কাঁচামালসহ অন্যান্য খরচ পড়ে ৫৫০ টাকা।
কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ এই পেশায় জড়িতদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন সামগ্রীর বাজার দখলের কারণে কমে এসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য শীতল পাটির চাহিদা। পাটি তৈরির কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যাও দিন দিন কমে আসছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া হতদরিদ্র এসব পাটি শিল্পীরা হয়তো আর বেশি দিন এ পেশা আঁকড়ে থাকতে পারবেন না।
১৫ নং ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ বলেন, বড়দারোগাহাট একটি প্রাচীন বাজার। এ বাজারে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি শীতল পাটিও বিক্রি হয়। মিরসরাই-সীতাকুন্ড উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এ বাজারে পাটি বিক্রি করতে আসে।