এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) : চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিস্তিন্ন পাহাড়ে কাসাভা চাষ হচ্ছে। রয়েছে চাষের অপার সম্ভাবনা। ইতমধ্যে উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হচ্ছে কাসাভা।
কৃষকদের কাছে এটি শিমুল আলু, কাঠ আলু ও ঠেংগা আলু নামেই বেশি পরিচিত। এ কাসাভা দিয়ে তৈরি করা হয় গ্লুকোজ, ফুড আইটেম, চিপস ও ওষুধের কাঁচামাল।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ৩৫০ একর পাহাড়ে কাসাভা আবাদ করেছেন কৃষকেরা।
স্থানীয়রা জানান, ১৮ বছর আগে এক প্রবাসী থাইল্যান্ড থেকে চারা এনে এলাকায় কাসাভা চাষ শুরু করেন। তখন ফসল কিনত ঢাকার ওষুধ কোম্পানি রহমান কেমিক্যাল। ২০১৭ সালে রহমান কেমিক্যাল বিক্রি হয়ে যায়। এরপর কাসাভা চাষে বিনিয়োগ শুরু করে প্রাণ কোম্পানী।
# ব্যবহার হচ্ছে খাদ্য সামগ্রী ও শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে
# আলু থেকে বেশি পুষ্টিগুন
# কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ দিচ্ছে প্রাণ কোম্পানী
জানা গেছে, কাসাভা চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে উপজেলার সঞ্জিত সাহা, মুক্তার হোসেন সহ অনেক কৃষকের। আগে পাহাড়ে আধা, হলুদ সহ নানা ধরণের সবজি চাষ করলেও তাতে বিক্রির আয়ের চেয়ে উৎপাদনে ব্যয় বেশী হতো। তাছাড়া সব সময় ভালো দামও পাওয়া যেতো না। রোগ প্রতিরোধে কীটনাশকে খরচ হতো বেশী। তাই এখন অল্প পুঁজি দিয়ে চাষ করেন কাসাভা। যাতে উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ বেশী হয়। এটি দেখতে শিমুল গাছের মত। মাটির ভেতর হয় কাসাভা। উচ্চ শর্করা সমৃদ্ধ কাসাভা হচ্ছে কন্দ জাতীয় ফসল। বৈজ্ঞানিক ভাষায় এটির নাম কাসাভা হলেও মিরসরাইয়ে এটি কাঠ আলু নামে পরিচিত। সব ধরণের জমিতে কাসাভা চাষ করা গেলেও পাহাড়ে এটির ফলন বেশী হয়। লাভজনক হওয়ায় কাসাভা চাষে ঝুঁকছে এখানকার কৃষকরা।
কাসাভা চাষী নুরুল আলম বলেন, বর্ষা মৌসুমে কাসাভা রোপণ করা হয়। কাসাভার বংশবিস্তার সাধারণত স্টেম কাটিংয়ের মাধ্যমে করা হয় ৮ থেকে ১২ মাস বয়সের মধ্যে। এটি ৫ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। বিগত ১২ বছর যাবৎ আমি এটি চাষ করে আসছি। এবছর ৬ একর জমিতে কাসাভা চাষ করেছি। দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ৫৫-৬০ টনের মতো কাসাভা হবে। এক বছরের মধ্যে কাসাবা বিক্রির উপযোগী হয়ে যায়। প্রতি টন কাসাভা ১২ হাজার টাকা ধরে বিক্রি করি।
কাসাভা চাষি মুক্তার হোসেন বলেন, বর্তমানে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্রাণ, স্কয়ার গ্রুপ আমাদের উন্নতমানের হাইব্রিড বীজ দেয়। তিনি আরো বলেন, কাসাভা কী সেটা এখনও অনেকেই জানে না। স্থানীয়রা ফলটি সম্পর্কে তেমন অবগত নয়। অথচ বড় বড় কোম্পানীগুলো কাসাভা নিয়ে গ্লুকোজ, চিপস বানাচ্ছে ও ওষুধের কাঁচামালও তৈরি করছে। রহমান কেমিক্যাল ও প্রাণ কোম্পানি বর্তমানে এখানকার উৎপাদিত কাসাভা কিনে নিয়ে যায় বলে তিনি জানান।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের ঘেড়ামারা এলাকায় তপ্ত দুপুরে পাহাড়ে কাসাভা গাছের গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করছেন শ্রমিকরা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে এর চাষাবাদ হয়ে আসলেও মিরসরাইতে শুধু করেরহাট ইউনিয়নের এর চাষবাদ লক্ষ্য করা গেছে।
জানা গেছে, কাসাভা হলো মূল জাতীয় খাদ্য। এটি গোল আলু, মিষ্টি আলু, মেটে আলুর মতো। এটি শক্তি ও তাপ উৎপাদন করে শরীরকে সতেজ ও কর্মক্ষম রাখে। শরীরের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকর্ম যেমনঃ শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া, হৃৎপিন্ড ও অন্যান্য দেহ যন্ত্রের ক্রিয়া, পরিপাক ক্রিয়া, মলমূত্র নিষ্কাষণ ক্রিয়া এবং দৈনন্দিন জীবনে সকল কাজকর্ম সম্পাদনে শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্ভাবনাময় ফসল কাসাবা হতে পারে দেশের অন্যতম খাদ্য।
পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য ফসলের একটি হচ্ছে এই কাসাভা। খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য এর আবাদের উপযোগিতা ধরা হলেও মূলত যেকোন মাটিতেই এর আবাদ সম্ভব। কাসাবার মূল মূলত খাদ্য উপাদান হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হলেও এর পাতা, কান্ড সবই খাদ্য উপযোগী। কাসাবা গাছের পাতার প্রোটিন এবং ডিমের প্রোটিনের মান সমান। কাসাবা চাষ বাণিজ্যিকভাবে সম্প্রসারণ করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারবে। আফ্রিকার দেশ সমূহে কাসাবা খাদ্য হিসেবে বেশী ব্যবহার করা হয়। এটি একটি লাভজনক চাষাবাদ।
প্রাণের ম্যানেজার (অপারেশন) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, তাদের কোম্পানি প্রতি একরে চাষিদের ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত সুদবিহীন ঋণ দেয়। ফসল ওঠানোর পর চাষিরা নিজ খরচে কোম্পানির হবিগঞ্জের কারখানায় কাসাভা পৌঁছে দেন। পরে ঋণের টাকা কেটে বাকি টাকা চাষিকে দেওয়া হয়।
ডায়েটিশিয়ান ও পুষ্টিবিদ মরিয়মুন নেছা বলেন, কাসাভায় সাধারণভাবে ৩০-৪০ ভাগ শর্করা, ১-২ ভাগ প্রোটিন ও ৫৫-৬০ ভাগ জলীয় অংশ বিদ্যমান। আর আলুর তুলনায় কাসাভাতে দ্বিগুণেরও বেশি শর্করা থাকে। তাই এটি আলুর থেকে অনেক বেশি পুষ্টিকর। এ ছাড়া শক্তিবর্ধক ও শরীরকে সতেজ ও কর্মক্ষম রাখে। তিনি আরও বলেন, সম্ভাবনাময় ফসল কাসাভা হতে পারে দেশের মানুষের নিয়মিত খাদ্যতালিকার একটি।
খাদ্যসামগ্রী
কাসাভার আটা দিয়ে রুটি ছাড়াও পাঁপর, চিপস, নুডলস, বিস্কুট, কেক, পাউরুটি ইত্যাদি তৈরি করা যায়। কাসাভা আলু যেমন সিদ্ধ করে খাওয়া যায়, তেমনই তরকারি করে মাছ-মাংসের সঙ্গে খাওয়া যায়।
শিল্পে কাঁচামাল
কাসাভা থেকে কেবল খাবারই তৈরি হয় না। এ থেকে তৈরি স্টার্চ ব্যবহৃত হয় শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে। কাসাভা স্টার্চ বর্তমানে বিদেশ থেকে আমদানি করা স্টার্চের যথার্থ বিকল্প। কাসাভা স্টার্চ টেক্সটাইল, ওষুধ ও রসায়ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও সিমেন্টের গুণগত মানোন্নয়ন, কাগজ, আঠা, প্রসাধন, রাবার ও সাবান শিল্পে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে স্টার্চ, মল্টোজ, লিকুইড, গ্লুকোজসহ অন্যান্য রূপান্তরিত চিনি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এমনকি সমরাস্ত্র কারখানায় বুলেট ডিটোনেশন কাজে ব্যবহৃত মোমবিহীন চাঁচ হিসেবে কাসাভার স্টার্চও ব্যবহার করা যায়।
করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন বলেন, কাসাভা চাষের পদ্ধতি খুব সহজ। খরচও তুলনামূলক কম। লাভও বেশি। সরকারি সহযোগিতা পেলে কৃষকেরা কাসাভা চাষে আরও উদ্বুদ্ধ হবে।
উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ কর্মকর্তা রঘুনাথ নাহা বলেন, কাসাভায় রয়েছে বিভিন্ন পুষ্টিগুণ। উচ্চ ক্যলোরিযুক্ত কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ ফসল এই কাসাভা। কাসাভা থেকে উন্নতমানের সাদা আটা পাওয়া যায় যা দিয়ে রুটি, বিস্কুট, চিপস, গ্লুকোজসহ নানাবিধ খাদ্য তৈরি করা যায়। এ ছাড়া শাগু, বিয়ার, পোলট্রিফিড, বস্ত্র ও কাগজ তৈরির শিল্পে প্রচুর কাসাভা ব্যবহার হয়। করেরহাটের ঘেড়ামারায় কাসাবা চাষি কৃষকদের নিয়মিত কৃষি পরামর্শ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিনহাজুর রহমান বলেন, দিন দিন কাসাভা চাষে স্থানীয় কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। চাষিদের এ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি অফিস থেকে সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া হবে।