গত আগস্ট মাসে সাগরে হঠাৎ ঝড় ও জলোচ্ছাসের কবলে পড়ে “এফ বি সামিরা” নামক একটি ট্রলার ডুবে যায়। এতে একজন জেলে মারা যায়। উক্ত ট্রলারের ১১ জন ও অন্য ট্রলারের ৫ জনসহ মোট ১৬ জন বাংলাদেশী জেলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জীবনতলা থানার দক্ষিণ মাউখালী, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মোহাম্মদ জীবন মোল্লার হেফাজতে রয়েছেন।
ভারতে আটকে পড়া এসব বাংলাদেশী জেলেদের দেশে ফিরিয়ে আনাসহ ৪ দফা দাবিতে বাংলাদেশ উপকূলীয় মৎস্য ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে রোববার ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ইং সকাল ৯টায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ৭৮/এ পুরানা পল্টন লেন (নিচ তলা) বিজয়নগর, ঢাকায় আলোচনা সভা ও সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
কর্মসূচিতে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ উপকূলীয় মৎস্য ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আনোয়ার হোসেন সিকদার বলেন, বিভিন্ন সময় সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে ভারতীয় সমুদ্রসীমায় প্রবেশের কারণে সে দেশের কোস্টগার্ড ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে আটকা পড়ে কারাগারে রয়েছেন প্রায় ২ শতাধিক বাংলাদেশী জেলে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাদের পরিবার দেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমার অবিলম্বে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাই।
তিনি বলেন, ট্রলার শ্রমিকরা ও বিভিন্ন বন্যা ও প্রতিকূলতার মধ্যে পড়লে ট্রলার শ্রমিকদের উদ্ধারে বাস্তব প্রদক্ষেপ নেওয়ার কেউ নাই। এজন্য সরকার নৌবাহিনী, কোষ্টগার্ড, নৌপুলিশ এদের দায়িত্ব দিয়েছে কিন্তুগভীর সমুদ্রে যাওয়ার মতো কোন শক্তিশালি নৌযান না থাকায় প্রতি বছর শত শত ফিসিং বোট ও ট্রলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফিসিং বোট ডুবে যাওয়ায় বোটের শ্রমিকরা মারা যায়। যে শ্রমিকরা প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে এবং দেশের আমিষের চাহিদা মিটাতে বিশাল ভূমিকা রাখে সরকার তাদের জীবন বাঁচাতে তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। ভুলবশত বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতে গেলে, ভারতীয় কোস্টগার্ড শ্রমিকদের আটক করে জেলে দেয়। তাদের ছাড়িয়ে আনতে পরিবারের সদস্যদের মাসের পর মাস ভারতে যেতে হয়, এতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। আটক বোটটি অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায় কিন্তু ভারতের কোন বাটে বাংলাদেশ আটক হইলে ভারতে হাই কমিশনার তাদের বোট ও শ্রমিকতে অল্প সময়ের মধ্যে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের হাই কমিশনারের সাথে শ্রমিকরা দেখা করাই মুশকিল হয়ে পড়ে এটা হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য।
“এফ বি সামিরা” ডুবির ঘটনার ভারতে যারা আটকা পড়েছেন তারা হলেন- ১) মোঃ বাবুল হোসেন বেপারি, পিতা- আবুল হোসেন, গ্রাম- দঃ দিয়ারাকচুয়া, পোঃ-কালাইয়া, থানা-বাউফল, জেলা-পটুয়াখালী। ২) মোঃ কামাল সরদার, পিতা- মৃত রতন, গ্রাম- উঃ দিয়ারা কচুয়া, পোঃ- কালাইয়া, থানা- বাউফল, জেলা- পটুয়াখালী। ৩) মোঃ জসিম বয়াতি, পিতা- মৃত আব্দুল করিম বয়াতি, গ্রাম- পঃ মিয়াজান, পোঃ- কালাইয়া, থানা- বাউফল, জেলা- পটুয়াখালী। ৪) মোঃ সুমন বেপারি, পিতা- মোসলেম, গ্রাম- দঃ মিয়াজান, পোঃ- কালাইয়া, থানা- বাউফল, জেলা- পটুয়াখালী। ৫) মোঃ সোহার মাঝি, পিতা- হোসেন, গ্রাম- উঃ মিয়াজান, পোঃ- কালাইয়া, থানা- বাউল, জেলা- পটুয়াখালী। ৬) মোঃ ফিরোজ খলিফা, পিতা- জাকির, গ্রাম- ছোটো টালিমা, পোঃ- ধানদি, থানা- বাউফল, জেলা- পটুয়াখালী। ৭) মোঃ সবুজ বেপারি, পিতা- হাসেম বেপারি, গ্রাম- রায়সাহেব, পোঃ- কালাইয়া, থানা- বাউফল, জেলা পটুয়াখালী। ৮) মোঃ আবুল মাতুব্বর, পিতা—মোননা আলি, গ্রাম—উঃ মিয়াজান, পোঃ—কালাইয়া, থানা—বাউফল, জেলা— পটুয়াখালী। ৯) মোঃ কায়েস হাওলাদার, পিতা— জামাল গ্রাম— দাস পাড়া, পোঃ— দাস পাড়া , থানা— বাউফল, জেলা— পটুয়াখালী। ১০) মোঃ কবির হোসেন, পিতা—মৃত খালেক বেপারি, গ্রাম—শিরিপুর, পোঃ—শিরিপুর, থানা—মেহেন্দিগঞ্জ, জেলা, বরিশাল। ১১) মোঃ মোতাহার, পিতা— নসু, গ্রাম— নাজিরপুর, পোঃ— নাজিরপুর, থানা— লালমোহন, জেলা—ভোলা। ১২) মোঃ হাসান গাজি, পিতা—ফোরকান, গ্রাম— কাউখালী, পোঃ—কাউখালী, থানা—রাঙ্গাবালি, জেলা— পটুয়াখালী। ১৩) মোঃ আব্দুল মালেক গাজি, পিতা—চান মিয়া, গ্রাম— হরিদ্রাখালী, পোষ্ট—কোড়ালিয়া, থানা—রাঙ্গাবালি, জেলা—পটুয়াখালী। ১৪) মোঃ শফিক মুন্সী, পিতা— হাসেম মুন্সী, গ্রাম— কাউখালী, পোষ্ট—কোড়ালিয়া, থানা— রাঙ্গাবালি, জেলা— পটুয়াখালী। ১৫) মোঃ নুরুল ইসলাম শিকদার, পিতা— আঃ কাদের, গ্রাম— ফুলখালী, পোঃ— বাহের চর, থানা— রাঙ্গাবালি, জেলা— পটুয়াখালী। ১৬) মোঃ আলম শিকদার, পিতা— আঃ কাদের, গ্রাম— কুলখালী, পোঃ— বাহের চর, থানা— রাঙ্গাবালি, জেলা— পটুয়াখালী।
মানববন্ধনে বঙ্গোপসাগরে সাম্প্রতিক জ্বলোচ্ছাস থেকে উদ্ধারকৃত নাসির বয়াতী, আব্দুল আলীমসহ অন্যান্য জেলেরা অংশগ্রহণ করেন। তারা বলেন, “এফ বি সামিরা” বোটটি ডুবে যাওয়ার পরে তুফানের তোড়ে রাতের অন্ধকারে না বুঝে বাংলাদেশী জেলেরা মধুখালীর বনে প্রবেশ করে। সকালে মাঝি-মাল্লাসহ জনাব মোহাম্মদ মোল্লা, গ্রাম- দক্ষিণ মউখালী, পোঃ- উত্তর মউখালী, থানা- জীবনতলা, জেলা- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, ভারত, পিনকোড-৭৪৩৩২৯, মোবাইল- ৯১৭৫৫৭৮০২০৪৫, +৯১৬২৯৬৫৩৩৬৪- এর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তাদের ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। সরকারিভাবে চিঠিপত্র প্রেরণ না করলে তাদেরকে ফেরত আনা সম্ভব হচ্ছে না। উল্লেখিত ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজন দুশ্চিন্তা ও মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা ১৬ জন সহ বিভিন্ন সময় দেশের সমুদ্র উপকূলে ঝড়ের কবলে পড়ে ভারতের বিভিন্ন কারাগারে যারা আটক রয়েছেন তাদেরকেও ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
কর্মসূচিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে ৪ দফা দাবি জানানো হয়, ১) ভারতে আটকে পড়া শ্রমিকদের অবিলম্বে ফিরিয়ে আনতে হবে। ডুবে যাওয়া ট্রলারের মৃত্যুবরণকারী মাঝি ও শ্রমিকদের প্রতি পরিবারকে প্রাথমিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা এবং প্রতি ট্রলারের ১৫ (পনের) লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ২) প্রতি ট্রলারের মাঝি, শ্রমিক ও জেলেদের নামে ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা গ্রুপ বীমা করে দিতে হবে। ৩) প্রতিটি ট্রলারের সন্ধানের লক্ষ্যে সীমান্ত রক্ষী নৌবাহিনী, কোষ্টগার্ড আওতায় থাকার জন্য প্রতিটি ট্রলারের ওয়াকিটকি দিতে হবে। সরকার প্রতি বোটে জীবনরক্ষাকারী আধুনিক বয়া দিতে হবে এবং দিক নির্ণয় করার জন্য সাগরের কিনারে রাডার বাতি স্থাপন করতে হবে। ৪) ট্রলার শ্রমিক ও জেলেদের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দকৃত মালামাল বন্টনের নামে লুটপাট বন্ধের লক্ষ্যে ট্রলার শ্রমিক প্রতিনিধি, নৌবাহিনী, কোষ্টগার্ড, নৌপুলিশ, মৎস্য বিভাগ ও শ্রম দপ্তরের প্রতিনিধির সমস্বয়ে কমিটি গঠন করতে হবে।
মানববন্ধনে আরো বক্তব্য রাখেন ইসরাঈল পন্ডিত, আবুল খায়ের, মোঃ শাহজাহান, মোঃ বাবুল মীর, আনন্দ চন্দ্র বর্মন, নান্নু মিয়া, শামসুল হক, খোকন মিয়া, আশরাফ আলী প্রমুখ।
মানববন্ধন শেষে ভারতে আটকে পড়া জেলেদের ফেরত আনার দাবিতে পররাষ্ট্র সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে আবেদন করা হয় এবং আগামী ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আটকে পড়া জেলেদের ফিরিয়ে আনতে দৃশ্যমান পদক্ষে গ্রহণ করা না হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘটের ঘোষণা দেওয়া হয়। – বিজ্ঞপ্তি