মাসুদ কামাল, সাংবাদিক

আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে- করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশের মানুষের মনে তেমন একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারেনি৷ বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য৷ তবে এটা ঠিক যে, শহর অঞ্চলগুলোতে মানুষ আগের তুলনায় কিছুটা বেশি মাস্ক পরছে৷

কিন্তু সেটা করোনার ভয়ে যতটা, তারচেয়েও বেশি প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে৷ মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস।’ এর পর থেকেই প্রশাসন যেন নড়েচড়ে উঠতে শুরু করে৷ তবে তাদের এই নড়াচড়া শহরাঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ৷রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় বা জেলা শহরের বাইরে গেলে বোঝারই উপায় নেই যে, মাস্ক পরার জন্য সরকারি কোন নির্দেশনা রয়েছে৷ আর মাস্ক পরাটা যে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যও জরুরি- সেই চেতনা তো আরও দূরের কথা৷গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো দৃঢ়মূল বিশ্বাস- ‘খেটে খাওয়া মানুষের কোভিড হবে না৷ এটা কেবলই বড়লোকের রোগ!’

এরই মধ্যে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন নিয়েও মানুষের মধ্যে দেখা গেছে নানা ধরনের বিভ্রান্তি৷ টেলিভিশন বা পত্রপত্রিকায় দেখা যাচ্ছে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন- ‘ভ্যাকসিন আসছে৷ সরকার বিনামূল্যে এই ভ্যাকসিন মানুষকে দেবে।’ সাধারণ মানুষ এতটুকুই শুনছে, আশাবাদী হয়ে উঠছে৷ সরকার বিনামূল্যে ভ্যাকসিনের কথা বলেছে, কিন্তু খোলাসা করে বলেনি- কবে নাগাদ পাওয়া যাবে সেই মহার্ঘ বস্তুটি৷ দেশের সকল মানুষের ভ্যাকসিন পেতে পেতে যে বছরও পেরিয়ে যেতে পারে, সে বিষয়টি কেউই সরাসরি বলছে না৷ফলে জনগণও জানতে পারছে না।

দিন দুয়েক আগে, ১৫ ডিসেম্বর বিকালে ট্রেনে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম৷ করোনা উপলক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে সরকারি নির্দেশনা, সেটা সেখানে দৃশ্যমান হলো না মোটেই৷ সকল আসনে যাত্রী, বোঝা গেল প্রতিটি আসনের জন্যই টিকেট বিক্রি করা হয়েছে৷ শারীরিক দূরত্ব রক্ষার লক্ষ্যে কদিন আগেও যে একটি করে আসন ফাঁকা রাখার সিস্টেম ছিল সেটা আর নেই৷ সেই সঙ্গে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে নারী-পুরুষ৷ এরই মধ্যে বিলি কেটে কেটে টিকেট চেকার ভদ্রলোক বগির এপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে হেঁটে গেলেন৷ কারও কাছে টিকেট দেখতে চাইলেন না৷ হাত পেতে, ভয় দেখিয়ে, যার কাছ থেকে যা পরলেন নিয়ে পকেটে ঢোকালেন৷ যাত্রীদের সিংহভাগের মুখেই কোন মাস্ক নেই, চেকার ভদ্রলোকের মাস্কটিও ঝুলে আছে থুঁতনির নিচে৷ করোনার চেয়ে তার বেশি মনযোগ মনে হলো নগদ অর্থ প্রাপ্তি নিয়ে৷

এরও কদিন আগে নগরীর কারওয়ান বাজারে গিয়েছিলাম৷ বাজারে মানুষের সমাগম দেখে মনে হয়নি- আমরা এখন করোনা প্যানডেমিকের মধ্যে রয়েছি৷

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার একটা বিষয় যে যথাযথভাবে পালনের প্রয়োজনীয়তা আদৌ রয়েছে, সেটিও বোঝা যায়নি মানুষের আচার আচরণে৷ পরিচিত এক মুরগী বিক্রেতা অনেকটা সুখবর দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন- “স্যার, করোনার ভ্যাকসিন তো চলে আসছে৷ এই আর কদিন, ব্যবসা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে!”

আমার মাথায় খেলা করে সরকারি কর্মচারি- ট্রেনের সেই টিকেট চেকারের অসঙ্গত আচরণ৷ কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীর আশাবাদ আমাকে উদ্দীপ্ত করে না৷ বরং এসবের বিপরীতে সরকারের উদ্যোগ দেখে উদ্বিগ্ন হই৷ সরকার কি ওই ক্ষুদে ব্যবসায়ীকে শীঘ্রই বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিতে পারবে? সরকারের কি সেই সক্ষমতা আছে? ভ্যাকসিনের চেয়ে শারীরিক দূরত্ব বজায়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরা- এসব কি কম গুরুত্বপূর্ণ?

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন কিভাবে আসবে, সাধারণ মানুষ এটা কিভাবে পাবে- এসব নিয়ে প্রথম সরকারি ভাষ্য পাওয়া গেল এ বছরের মাঝামাঝি৷ জুলাই মাসের ২০ তারিখ সকালে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’র এক বিশেষ সভায় স্বাস্থ্যসচিব জানালেন, ভ্যাকসিন দেশে এলে দেশের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষকে বিনামূল্যে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে৷

তখনও অবশ্য জানা যায়নি ভ্যাকসিন আমরা কোথা থেকে পাব৷ কিনতে হলে কোথা থেকে কিনতে হবে, সেজন্য কত মূল্যই বা দিতে হবে৷ আমেরিকা, বৃটেন, রাশিয়া, চীনসহ অনেক কটি দেশই তখন ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতায় ছিল৷ এর মধ্যে শোনা গেল চীন তাদের ভ্যাকসিন তৈরির ট্রায়ালের জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে৷ বাংলাদেশে ট্রায়াল হলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে, দামেও হয়তো সুবিধা পাবে৷ পরে আবার জানা গেল, না- চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশে হচ্ছে না৷ কেন হচ্ছে না? এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট অফিসিয়াল কোন জবাব পাওয়া গেল না৷ ভাসা ভাসা শোনা গেল, চায়নার পক্ষ থেকে নাকি ট্রায়ালের জন্য একটা ফি চাওয়া হয়েছিল৷ আর সেটা দিতে রাজী হয়নি বাংলাদেশ৷ সেটাই কি একমাত্র কারণ, নাকি এর পিছনে ভূ-রাজনৈতিক অন্য কোন কারণ কাজ করছে- তা নিয়েও বিস্তারিত কোন আলোচনা হয়নি৷ তবে কারণ যেটাই হোক, তার ফল যে আমাদের জন্য দারুণ কিছু সুখকর হয়নি, সেটা বোধকরি বলা যায়৷ ভ্যাকসিন প্রাপ্তি বিষয়ক পরবর্তী আলোচনার দিকে তাকালে তার অনেককিছুই স্পষ্ট হয়ে যাবে৷

করোনা ভ্যাকসিন বানানোর ইঁদুর দৌড়ে অনেকেই এখন একেবারে চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে৷ তবে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে সম্ভবত ফাইজার ও বায়োএনটেক৷ এদের তৈরি ভ্যাকসিন এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার শুরু করেছে৷ এ ভ্যাকসিনটি সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রযুক্তিতে তৈরি৷ এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর আগে পৃথিবীতে কখনো কোন ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি৷ ফলে এর দীর্ঘমেয়াদী কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা- সেটাও সুনিশ্চিতভাবে বলা যাবে না৷ তারও চেয়ে বড় কথা, দু’টি কারণে আমাদের দেশের জন্য এটি তেমন একটা লাগসই হবে না৷ প্রথম কারণটি হলো, এই ভ্যাকসিনকে সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়৷ এত কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনো নাই৷ দ্বিতীয়ত, আর এর দামও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি৷ খোদ যুক্তরাষ্ট্রই এই ভ্যাকসিনের প্রতিটি ডোজ কিনছে ৩৯ ডলার করে৷ একজন মানুষকে কোভিড প্রতিরোধী করতে এই ভ্যাকসিনের দুটি করে ডোজ দিতে হবে৷ তার সঙ্গে যোগ হবে ভ্যাকসিনেশনের ব্যয়, সবমিলিয়ে সেটা ১০০ ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে৷ সন্দেহ নেই আমাদের মত দেশের জন্য এটা অনেক টাকা৷

বিপরীত দিকে, আমরা যে ভ্যাকসিনটি কেনার জন্য মনস্থির করেছি, ইতোমধ্যে চুক্তিও করে ফেলেছি, সেটা হচ্ছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-এস্ট্রাজেনকো’র ভ্যাকসিন৷ এটিকে বলা যায় ‘তৃতীয় বিশ্বের ভ্যাকসিন।’ এটার মূল্য খুবই কম রাখা হয়েছে৷ প্রতিটির দাম মাত্র তিন ডলার৷ বিশ্বের দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্রয়ক্ষমতার কথা চিন্তা করেই যেন এই ভ্যাকসিনটি বানানো হয়েছে৷ অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনকো শুরু থেকেই বলে আসছে যে, করোনার ভ্যাকসিন বানিয়ে তারা তেমন কোন মুনাফা করতে চায় না৷ উৎপাদন ব্যয়েরই দিতে চায়৷ আমরা যে চুক্তিটি করেছি, সেটা অবশ্য অক্সফোর্ড বা এস্ট্রাজেনকোর সঙ্গে নয়৷ বাংলাদেশ ভ্যাকসিনটি আনতে চাইছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে৷ সেটাও আবার সরাসরি নয়, সেরামের কাছ থেকে আমরা পাবো বাংলাদেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালের মাধ্যমে৷ কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ হিসাবে বেক্সিমকো কিভাবে ঢুকে পড়লো, সেটা অবশ্য দেশে এখন বহুল উচ্চারিত একটি প্রশ্ন৷ সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও এর ফলাফল সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেছে৷ তিন ডলারের ভ্যাকসিন আমাদেরকে কিনতে হচ্ছে ৫ ডলার করে৷ এই দাম দিয়েই সরকার কিনছে৷ অনেকে অবশ্য জানতে চাইছে- এই চুক্তিটি কি সরকারের সঙ্গে সরকারের মধ্যে হতে পারত না? কিংবা যদি মাঝখানে কোন ওষুধ কোম্পানীর থাকাটা খুবই জরুরি হয়েই থাকে, তাহলে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডিসিএলকে রাখা যেত না? এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে- বেক্সিমকোর মালিকানার সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তি খোদ প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা, এবং বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাতীয় সংসদের একজন প্রভাবশালী সদস্য।

উত্তরবিহীন এতসব প্রশ্ন সত্ত্বেও একটা বাস্তবতা কিন্তু এই যে, তারপরও অন্যসব ভ্যাকসিনের তুলনায় কম দামেরটিই কিনছি আমরা৷ প্রথম দফায় আমরা কিনব মোট তিন কোটি ভ্যাকসিন৷ প্রতিজনকে দুটি করে ডোজ দিতে হবে৷ এতে করে এই ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে মোট দেড় কোটি মানুষকে৷ এই দেড়কোটি ভাগ্যবান ব্যক্তি কারা হবেন? এই বিতর্ক নিরসনে একটা নীতিমালা করা হয়েছে৷ বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরি করা হয়েছে৷ স্বভাবতই সেই ক্যাটাগরির একেবারে সামনের দিকে রয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীরা ৷ ডাক্তার, নার্সসহ যারা সবসময় রোগীদের সংস্পর্শে থাকেন তাদেরকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে৷ এর পরের ধাপগুলোতে জরুরি সেবাকর্মের জড়িত বিভিন্ন পেশার লোকেরা থাকবেন৷ চূড়ান্ত তালিকাটি ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০) পর্যন্ত প্রকাশ করা না হলেও প্রস্তাবিত যে তালিকা পাওয়া গেছে তার মধ্যে আমলা, সাংবাদিক, জন প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতারাও রয়েছেন৷ এ থেকে এতটুকু অন্তত ধারণা করা গেছে যে, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সঙ্গে ক্ষমতার একটা সম্পর্ক রয়েছে৷ যে যত ক্ষমতাবান তার বেঁচে থাকার অধিকার তত বেশি!

শেষ অব্দি তালিকার চেহারা যেটাই হোক না কেন, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এতটুকু অন্তত বলা যায়, সরকার কর্তৃক প্রণীত তালিকাও হয়তো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হবে না৷ কারণ বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদেরকে ট্যাডিশনালি দেওয়া হয়ে থাকে, দুর্নীতি তাদের মজ্জাগত৷ এক্ষেত্রে আমরা উন্নত বিশ্বের কিছু উদাহরণও দিতে পারি৷ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে নানা দুর্নীতির খবর পাওয়া গেছে৷মানুষের আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন জালিয়াত চক্র মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে৷ এফবিআই, অভিবাসন ও শুল্ক বিভাগ ইতোমধ্যে এই জালিয়াত চক্রকে থামাতে মাঠে নেমেছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশেই যদি এই ভ্যাকসিন নিয়ে এমন বেসাতি হয়ে থাকে, তখন আমাদের মত দুর্নীতিপ্রবণ দেশে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়৷সম্ভাব্য সেরকম দুর্নীতি প্রতিরোধে আমাদের আগে থেকেই কোন পূর্বপ্রস্তুতি রয়েছে কি-না, সেটাও স্পষ্ট নয়৷

বিশেষজ্ঞদের মতে কেবল ভ্যাকসিন কিনতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না৷ এর পরের ধাপ, অর্থাৎ ভ্যাকসিনেশনটাও সম্পন্ন করতে হবে সুচারুভাবে৷ একটি ভ্যাকসিন নেওয়ার নির্দিষ্ট সময় পর নিতে হবে আরও একটি ডোজ৷ দ্বিতীয় ডোজটি সবাই ঠিকঠাক মত নিতে পারবে কি-না, কিংবা নেওয়ার পরিবেশ ও সুযোগ সে পাবে কি-না, সেসবও দেখতে হবে৷ তারপর রয়েছে ভ্যাকসিনের মেয়াদ সংক্রান্ত প্রশ্ন৷ কতদিন থাকবে এর মেয়াদ, অর্থাৎ শরীরে প্রবেশের পর কতদিন এটি কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সক্ষম থাকবে- এ বিষয়েও নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি৷ তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে আলোচিত বেশিরভাগ ভ্যাকসিনের মেয়াদ হবে ছয় মাস৷ সেক্ষেত্রে একবার ভ্যাকসিনেট করার ছয় মাস পর কি আবার সেই প্রথম ধাপের ব্যক্তিদেরকেই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে, নাকি নতুন কিছু মানুষকে দেওয়া হবে? নতুনদেরকে দেওয়া হলে পুরানোরা আবার কি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে না? এ জটিলতা থেকে আমাদের তখনই কেবল মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে, যখন আমরা একবারে দেশের আশি শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনেট করতে পারব৷ ফলে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন এখন- দেশের আশি শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে আমাদের কত বছর সময় লাগবে? অথবা আদৌ কি সেটা সম্ভব হবে আমাদের সরকারের পক্ষে?

এদিকে আর এক জটিলতা দেখা দিয়েছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের অনাকাঙ্ক্ষিত এক জটিলতার কারণে৷ তৃতীয় স্তরের ট্রায়াল তাদের আরও একবার করতে হচ্ছে৷ সেটা যদি অতি সফলভাবেও সম্পন্ন হয়, তারপরও আগামী ফেব্রুয়ারির আগে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন পাওয়ার কোন চান্স নেই৷ ঠিক এই অবস্থায় এসে দেখা যাচ্ছে, বিকল্প হিসাবে চীন বা রাশিয়ার ভ্যাকসিন আনার চিন্তা না করে আমরা বেশ বড় একটা ঝুঁকির মধ্যেই পড়ে গেছি৷ আসলে এটাই নিয়ম, গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে সবসময়ই বিকল্প অপশন রাখতে হয়৷ এই যে আমেরিকা এত দাম দিয়ে ফাইজারের ভ্যাকসিন নিচ্ছে, তারাও কিন্তু বিকল্প রাখছে, একাধিক কোম্পানীর ভ্যাকসিন কেনার জন্য চুক্তি করছে৷ যুক্তরাজ্যও চুক্তি করেছে ৫টি কোম্পানির সঙ্গে৷ আর আমরা ‘মহাজ্ঞানীর’ একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই চুক্তি করে নিশ্চিন্তে বসে আছি!

এমন একটা বাস্তবতায় এসেও আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা কিন্তু আছেন খুবই নিশ্চিন্তে৷ এই ১৬ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বললেন- জানুয়ারির শেষ দিকে দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আনা হবে৷ তিনি আরও বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি৷ করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব আজ বাংলাদেশকে নিয়ে প্রশংসা করছে।’ এমন স্তুতি একশ্রেণীর মানুষের আত্মতৃপ্তি বাড়াতে পারে, তাদের চাকরি নিশ্চিত করতে পারে, কিন্তু কোভিড-১৯ এর মত অতিমারিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

করোনা প্যানডেমিক দুনিয়াজুড়ে মানুষকে এখন একটা বড় প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ মানুষের মধ্যে বিভাজনটাকে স্পষ্ট করে দিয়েছে৷ এ নিয়ে সেদিন কথা হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমানের সঙ্গে৷ ভ্যাকসিনের চলমান চালচিত্র নিয়ে তেমন একটা আশাবাদী মনে হলো না তাঁকে৷ তাঁর মতে, পুরো জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ মানুষকে কার্যকর ভ্যাকসিন দেওয়া না গেলে মানুষ কিন্তু ঝুঁকির মধ্যে থেকেই যাবে৷ যেভাবে চলছে, তাতে ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে দিতে আর তিন চার বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে৷ অথচ সেটা সম্ভব না হলে, তখন বরং পৃথিবীই ভ্যাকসিন ‘দেওয়া’ আর ‘না দেওয়া’- এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে৷ আজ দুনিয়াজুড়ে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বিভেদ থাকলেও পরস্পরকে তারা অন্ততপক্ষে অস্পৃর্ষ বলে বিবেচনা করে না৷ আগামীতে সে আশঙ্কা তৈরি হতে পারে৷ভ্যাকসিন না দেওয়া লোকের পাশে হয়তো ভ্যাকসিনেটেড মানুষটি বসতে চাইবে না৷বৈষম্য দেখা যাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রেরও৷ এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেওয়া আছে কিনা- সেটা একটা শর্ত হিসাবে বিবেচিত হতে পারে৷ একপক্ষ অপরপক্ষের দিকে তাকাবে সন্দেহের চোখে৷

কোভিড ভ্যাকসিন কি পুরো মানবজাতিকেই মর্মান্তিক এক বিভেদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে? – ডয়চে ভেলে