ঘিওরের পয়লা ইউনিয়নের হাইস্কুল মাঠে মেলা। ছবি: প্রতিনিধি
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) : আজ পহেলা বৈশাখ। বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ। নববর্ষকে বরণ করতে আগ্রহের কোনো কমতি নেই ঘিওর উপজেলাসহ মানিকগঞ্জের গ্রামীণ জনপদের মানুষজনের। পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে বিভিন্ন স্থানে বসছে বৈশাখী মেলা। আর এ মেলাকে সামনে রেখেই উপজেলার প্রায় ১০ হাজার তাঁত, হস্ত, মৃৎশিল্পী, সাজ কদমা আর মিষ্টির কারিগড়রা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পার করছেন ব্যস্ত সময়। বাড়ির পুরুষদের কাজে সহযোগিতা করছেন নারী ও শিশুরাও।
গত দুই বছর করোনা ভাইরাসের কারনে মেলা বন্ধ ছিল। ফলে এসব পেশার সাথে জড়িতরা অনেকটাই মানবেতর জীবন পার করেছেন। এবার সরকারীভাবে বড় মেলা কিংবা জনসমাবেশ এর ব্যাপকতা না থাকলেও উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ছোট বড় ২০ টি স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও সরকারী ও বিভিন্ন এনজিওর আয়োজনেও পালিত হচ্ছে বৈশাখী মিলন মেলা। এক থেকে ৭ দিন পর্যন্ত থাকবে এসব মেলা। এসব মেলাজুড়ে বসছে নানা দোকান পাট। এর মধ্যে তাঁতের কাপড়, রঙিন পাখা, সুণিপুণ হস্ত কারুকাজের জিনিসপত্র, মৃটির তৈজসপত্র, শিশুদেও খেলনা, সাজ কদমা আর বাহারী মিষ্টির দোকান অন্যতম। তবে পবিত্র রমজান মাস থাকায় দিনের বেলা তেমন না জমলেও সন্ধ্যার পর লোকসমাগম বেশি হবে বলে জানান একাধিক ব্যবসায়ীরা।
বুুধবার সকালে ঘিওরের জাবরা পাল পাড়ায় সরজমিন দেখা যায়, কর্মমুখর পাল পাড়ায় হচ্ছে নানা আকারের পাত্র তৈরি। পণ্য তৈরি শেষে উঠোনজুড়ে রোদে শুকানো হচ্ছে তা। সবশেষে দেয়া হচ্ছে রং তুলির আঁচড়। এখানকার পণ্য নিয়ে আজই বেরিয়ে পড়বেন বিভিন্ন অঞ্চলের বৈশাখী মেলায়। মেলায় নিজেদের বানানো পণ্যের পসরা সাজিয়ে বিক্রি করবেন তারা।
বানিয়াজুরী ইউনিয়নের জাবরা পাল পাড়ায় রাত সাড়ে দশটায় শিশুকে বসিয়ে রেখে বাবা-মায়ের কর্মব্যস্ততা। ছবি: প্রতিনিধি
উপজেলার জাবরা, মির্জাপুর, কাঁলাচাদপুর, নালী, সিংজুরী, পয়লা, বড়টিয়াসহ ২০ টি গ্রামে কমপক্ষে ৪/৫ হাজার পাল পরিবার এখনো মাটির তৈজসপত্র ও খেলনা সামগ্রী তৈরী ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। পাল পাড়ার মৃিশল্পী, তরণী পাল, প্রবীণ সুখেন পাল ও গৃহবধ‚ শিল্পী রানী পাল জানান, তারা প্রত্যেকেই মেলার জন্য মাটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও তৈজসপত্র তৈরি করছেন। চাহিদার কথা চিন্তা করে পুতুল, ব্যাংক, আম, কাঁঠাল, হরিণ, ঘোড়া, হাতি, মাছ, ময়ুর, সিংহসহ হরেক রকম শিশু খেলনা, ঘর গৃহস্থালীর হাড়ি, পাতিল, ঢাকনা, ঝাঁজর, কলসসহ নানান তৈজসপত্র, ঘর সাজানোর জন্য ফুলদানি, টবসহ নানান জিনিসপত্র তৈরী করছেন।
হরেক স্বাদের মিষ্টি ছাড়া বৈশাখী মেলা কল্পনাও করতে পারে না মানিকগঞ্জের লোকজন। এছাড়াও সারাদেশেই রয়েছে মানিকগঞ্জের মিষ্টির কদর। রসগোল্লা, জিলাপী, দধি, মাসকলাই আমিরতী, রসমালাই, সন্দেশ, কালোজাম, চমচম তৈরী করতে দুধ, চিনি, গুড়, মাসকলাইসহ অন্যান্য উপকরণ ক্রয় এবং মিষ্টি তৈরী করার কাজে দম ফেলার ফুসরত নেই ঘোষপাড়ার নারী-পুরুষদের।
ঘিওরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি বিক্রির প্রতিষ্ঠান নিজাম সুইটমিটের ব্যবস্থাপক মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের মিষ্টির চাহিদা এমনিতেই ব্যাপক। এছাড়াও পহেলা বৈশাখে অতিরিক্ত ৪০/৫০ মণ মিষ্টি বিক্রি বেশি হবে। তাই কারিগররা এখন ভীষন ব্যস্ত।
ঘিওর সদর ইউনিয়নের কালাচাঁদপুর গ্রামের মেলায় মিষ্টির দোকান। ছবি: প্রতিনিধি
উপজেলার প্রায় সহস্রাধীক লোক তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত। বৈশাখী শাড়ি, লুঙ্গি, বাহারী রংয়ের গামছা তৈরির কাজে তাঁত শিল্পীদের ঘুম নেই চোখে। উপজেলার পুখুরিয়া এলাকার তাঁত মালিক আবদুল বাসেত মিয়া জানান, বছরের অন্যান্য সময় কদর কম থাকলে পয়লা বৈশাখ ও ঈদ-প‚জায় রোজগার বেড়ে যায়।
কুটির শিল্পীরা বাঁশ বেত সামগ্রী, রঙিন হাতপাখা, মোড়া, টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট, ট্রে, ফুলদানি, ছাইদানি, শিশুদের খেলনা সামগ্রীসহ ঘর গৃহস্থালীর নানাবিধ উপকরণ তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ঘিওরের জাবরা, পয়লা, ঘিওর সদর, আশাপুর, শ্রীবাড়ি এলাকার দেড় হাজারেরও বেশি লোকজন এ পেশার সাথে জড়িত। বেশাখী মেলাকে ঘিরে তারা কর্মমুখর সময় অতিবাহিত করছেন। শ্রীবাড়ি গ্রামের বাঁশ-বেত শিল্পের কারিগড় প্রবীণ সুখেন দাস বলেন, ভোর বেলা থেকে কাজ শুরু করি। মাঝ রাত পর্যন্ত কাজ করছি পরিবারের সবাই। ঢাকার একটি বড় অর্ডার পেয়েছি, আজ সব মালপত্র বুঝে দিতে হবে।
উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, তাঁত, হস্ত, মৃৎশিল্পী, কুটির শিল্প, মিষ্টির কারিগড়সহ বৈশাখী উপলক্ষে দশ হাজারের মতো লোকজন সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাদের পুরো বৈশাখ মাসজুড়ে থাকবে ব্যস্ততা। ম‚লত এই মাসকে টার্গেট করেই তারা প্রতীক্ষায় থাকেন।
বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক এর মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক কর্মকর্তা বিমল রায় বলেন, এ পেশার সাথে জড়িত রয়েছে দশ হাজারেরও বেশি মানুষজন। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষক ও সহজ শর্তে সরকারী পর্যায়ে ঋণ প্রদান করলে তারাদেও কুটির শিল্পের প্রসারিতা আরো বৃদ্ধি পাবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: হামিদুর রহমান বলেন, বৈশাখ মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব। নতুন বর্ষকে বরণের পাশাপাশি উৎসবকে পরিপ‚র্ণতা দেয় বৈশাখী মেলা। এসব পেশার সাথে জড়িতরা অনেকটাই মানবেতর জীবন যাপন করছে। এসব শিল্পী ও কারিগড়দের উন্নয়নে সরকার কাজ কওে যাচ্ছেন। পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে বাঙালীর আদি ঐতিহ্য।