এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) : নদী মাতৃক বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়ের প্রতিটি বহরের সাথে ‘সাপ’ ছিল তাদের একটা বিশেষ অংশ। তারা ছিল যাযাবর। জীবন চলার পথে বছরের কয়েকটি মাস কয়েকটি স্থানে ভ্রাম্যমান শিবির টাঙিয়ে তারা বসবাস করে। এরপর জীবিকা হিসেবে কেউ বানর, কেউ সাপ, কেউ বা অন্য কোনো পেশায় নিযুক্ত থেকে বসবাসকৃত এলাকার বিভিন্ন বাড়ীতে বেদেনীরা সাপ নাচিয়ে খেলা দেখাত। আবার তাদের পুরুষ সঙ্গীরা জীবিকা নির্বাহ করত সাপ, বানর কিংবা অন্য কোন কর্ম করে। এদিকে পুরুষ সাপুড়েগণ গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে সাপ নাচিয়ে লোক জড়ো করে খেলা দেখিয়ে কিংবা ওষুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। বর্তমানে কালের আবর্তে পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া সেই পেশা ছেড়ে তারা এখন অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। ফলে এখন আর আগের মত গ্রামের মেঠোপথে কিংবা হাট-বাজারে এসব খেলা দিখিয়ে মানুষের জটলা আর দেখা যায় না। বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন পূর্বে ভাসমান জীবনযাপন করলেও বর্তমানে নদ-নদী, খাল-বিল চলাচল অনুপযোগী হওয়ায় নৌকায় অবস্থান না করে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী ও অস্থায়ী আবাস গড়ে তুলছে। কমে আসছে তাদের সংখ্যাও।
গ্রাম-গঞ্জে কিংবা শহরে বিভিন্ন অঞ্চলে বীণ বাজিয়ে নেচে, গেয়ে বিষধর সাপের খেলা দেখিয়ে দর্শকের মন মাতিয়ে সামান্য আয়েই চলে বেদেদের জীবন জীবিকা। দর্শকদের মন ভুলিয়ে মানুষ জমিয়ে তাবিজ বিক্রি করে প্রতিদিন আয় করে ২-৩ শত টাকা। নিজ পরিবারসহ আরো কয়েকটি পরিবার নিয়ে নিজের জেলা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দুর-দুরান্তে জীবিকা নির্বাহের জন্য ছুটতে হয় তাদের। একসঙ্গে প্রায় ১৫-২০ টি পরিবার নৌকাযোগে নদী পথে বিভিন্ন এলাকায় নোঙ্গর করে খুপনি বানিয়ে তার ভেতর এক অঞ্চলে প্রায় মাসব্যাপি থেকে এভাবে সারা বৎসর ধরে তারা এ পেশার মাধ্যমে আয় করতে থাকে। এদের কাছে প্রায় ৮-১০ টি প্রজাতির বিষধর সাপ থাকে।
গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে একসময় গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাপ ধরা ও সাপের খেলা দেখিয়ে, তাবিজ বিক্রিসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসার কথা বলে ঘুরে বেড়াতো বেদেরা (যদিও এসব অপচিকিৎসার কোন ভিত্তি নেই) তবুও মানুষ ক্ষণিকের বিনোদনে মাতোয়ারা হয়ে এসব তাবিজ-কবজ কিংবা ঔষুধ কিনত। এখন সেই সাপ খেলা সচরাচর দেখা যায় না।
উত্তরাঞ্চল থেকে মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বাজারে সাপ খেলা দেখাতে আসা বেদে কালাচাঁদ সর্দার জানায়, সাপের বিষ দিয়ে অনেক দুরারোগ্য রোগ সারার ঔষুধ তৈরী হয়। এগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাদের অনেকে সাপের বিষাক্ত ছোবলে প্রাণ হারিয়েছে। তিনি আরও জানান, সাপ ধরার কোন মন্ত্র নেই। আছে বুদ্ধি, সাহস আর কলা-কৌশল। সাপ ধরার সময় কোন চালের ব্যত্যয় ঘটলে তাকে প্রাণ হারাতে হয়। আর তাবিজে বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থাকে। গাছ-গাছড়ার দ্রব্যগুণ আছে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তাই আমরা এগুলো বিক্রি করে, বিভিন্ন হাট-বাজারে বীন বাঁজিয়ে সাপের নাচন দেখিয়ে দর্শক মাতাই এবং তাবিজ বিক্রি করে দিনে ২-৩ শত টাকা আয় করে চালাতে হয় নিজ সংসার। সংসার চললেও এ পেশায় জীবনের ঝুঁকি রয়েছে।
আরেক সাপুড়ে সাইফুল জানান, আমাদের দেশে বর্তমানে দাঁড়াশ, চন্দ্রমুখী, কাল নাগিনী, গোঁখড়ো, দুধমনি, পঙ্খীরাজসহ বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ সাপ রয়েছে। তবে এগুলো পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। আমাদের সংগ্রহেও আছে। তবে আগের মতো সাপ খেলা দেখিয়ে কিংবা ঔষধ বিক্রয় করে সংসার চালানো যায় না। আগের মতো সাপও পাওয়া যায় না। তাই কালের আবর্তে সাপুড়েদের মত ঝড়-বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এরাও হারিয়ে যাচ্ছে।
মিরসরাইয়ের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাষ্টার এম গিয়াস উদ্দিন জানান, সাপ নাচানো অর্থাৎ সাপের খেলা এক সময় বাঙালীর বিভিন্ন বিনোদন একটি ছিল। প্রকৃতি থেকে সাপ হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন পেশা বদল করায় এবং প্রকৃতি থেকে সাপের আবাসন কমার ফলে আগের মত আর সাপ খেলা দেখা যায় না।