আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) : ঘিওর উপজেলাসহ মানিকগঞ্জে যে বিস্তীর্ণ জমিতে কয়েক বছর আগেও ধান, গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসল চাষ হতো সেখানে এখন চাষ করা হচ্ছে ক্ষতিকর তামাক। কৃষি জমিতে তামাক আবাদের ফলে কমছে খাদ্য শস্য উৎপাদন।

সেই সাথে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে নারী-শিশুরাসহ কৃষক পরিবারের লোকজন। তামাক চাষ হওয়ায় একদিকে যেমন কৃষি জমি ধ্বংস হচ্ছে, অপরদিকে হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ।

জানা গেছে, বিভিন্ন বিভিন্ন টোব্যাকো কোম্পানির কাছে কৃষকরা হেরে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অর্থের লোভ দেখিয়ে তাদের এ চাষ করানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন কৃষকরা। তামাক পাতা সংগ্রহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা রকমের সহযোগীতা, অগ্রিম অর্থ প্রদান এবং তামাক পাতা নিশ্চিত বিক্রির কারণে তামাক চাষে আগ্রহী ঘিওর উপজেলাসহ মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাষিরা।

তামাক চাষ ক্ষতিকর জেনেও অগ্রিম টাকা পাওয়ার কারণে গ্রামাঞ্চলের চাষিরা তামাক চাষে ঝুকছে বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্টরা। তামাক চাষের জমি তৈরির সময় থেকে বিক্রি পর্যন্ত দেখাশুনা করেন বিভিন্ন তামাজাত কোম্পানীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। প্রান্তিক পর্যায়ে তামাক চাষে নানা রকমের প্রণোদণার কথা বলে কৃষকদেরকে তামাক চাষে রাজি করান এসব কর্মকর্তারা।

কৃষকরা জানান, এককালীন টাকার পাওয়ার কারণে তারা এ কাজ করেন। ফলে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে তামাক চাষ। অধিক লাভের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন থেকে দ‚রে ঠেলে করানো হচ্ছে তামাক চাষ। চাষের নিয়ম কানুন না থাকার কারণে বেপরোয়াভাবে তামাক চাষের কারণে নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন এলাকার কৃষক পরিবারের সদস্যরা।

তামাক পাতা উত্তোলনের সময় হাতে হ্যান্ড গøাভস, মুখে মাস্ক থাকা আবশ্যক কিন্তু এসব এলাকার কৃষকেরা তার কোনোটিই ব্যবহার করছে না। শুধু কৃষকরাই নয় এ কাজে নারী ও শিশুরাও জড়িত। এ তামাক পাতাগুলো বাড়ির আঙ্গিনা, উঠান এমনকি ঘরের ভিরতেও শুকানো হচ্ছে।

অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য, স্বাস্থ্যঝুকি বিশেষ করে শ্বাস কষ্টের রোগীদের নানা সমস্যাসহ গবাদী পশুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঘিওর উপজেলার সিংজুরী, বড়টিয়া, বালিয়াখোড়া, শিবালয়ের বুতনী, মহাদেবপুর, ঢাকাইজোড়ো, সদর উপজেলার গড়পাড়া ইউনিয়ন, সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লী, বরাইদ, হরগজ, দিঘুলীয়া, ফুকুরহাটি, গোবিন্দপুর ও দড়গ্রাম ইউনিয়নের সাধারণ কৃষকরা তামাক কোম্পানির কাছ থেকে টাকা দাদন নিয়ে তামাক চাষ করছেন। ইতিমধ্যে সকল প্রকার আবাদী ফসল চাষ কমিয়ে দিয়ে তামাক ক্ষেতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে শিশু নারীসহ পরিবারের সকল সদস্যরা।

ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া গ্রামের তামাক চাষী সিরাজ মিয়া বলেন, এ বছর আমি ৫ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন। প্রতি বিঘায় ৮ থেকে ৯ মণ তামাক উৎপাদন হয়। এ সমস্ত তামাক ৯৫ থেকে শুরু ১৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হয়। আমি আকিজ টোব্যাকো এবং ব্রিটিশ আমেরিকা টোব্যাকো কোম্পানির কাছে তামাক বিক্রয় করি। এতে করে আমি একেবারে একালীনভাবে তামাকের টাকাগুলো পাচ্ছি। অন্যান্য ফসল চাষ করে এভাবে এককালীন টাকা পেতাম না।

ঘিওরের সিংজুরী গ্রামের তামাক চাষী আতোয়ার রহমান জানান, তিনি এ বছর ৭ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন। তিনি একটি টোব্যাকো কোম্পানিকে এই তামাকগুলো সরবরাহ করবেন। কোম্পানী থেকে অগ্রিম টাকা দেয় আবাদের জন্য।

সাটুরিয়ার তিল্লী গ্রামের নাছরিন বেগমের কাছে হ্যান্ডগ্লাফস এবং মাস্ক ছাড়া তামাক পাতা শুকাতে দেখা গেলে তাকে এ বিষয়ে বলার পর তিনি বলেন, “আমি গ্রামের মানুষ, এত কিছু বুঝি না। তবে খালি মুখে তামাক নাড়াচাড়া করলে আমাদের মাথা ঘুড়ায়, মাঝে মাঝে বমি বমি ভাব হয়।

কৃষি সম্পাসারণ অধিদপ্তর স‚ত্রে জানা যায়, জেলায় প্রায় এক হাজার দুইশত হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে, যা গতবারের চেয়ে প্রায় তিনশত হেক্টর কম। ঘিওর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ বিপুল হোসেন বলেন, তামাক আবাদে জমির উর্বরতার অনেক ক্ষতি হয়। আমরা কৃষকদের নিরুৎসাহী করি, এর পরিবর্তে সবজী ও অন্য ফসল আবাদ করার নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু তারা নগদ টাকার লোভে তামাক চাষ করেন। তবে দিন দিন এর আবাদ কম হচ্ছে। গত বছর ঘিওর উপজেলায় ৭৫ হেক্টর জমিতে তামাক আবাদ হয়েছিল, চলতি বছর তা ৪০ হেক্টরে নেমে এসেছে।

এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডাঃ সুজিত কুমার সরকার বলেন, তামাক চাষের ফলে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে তামাকের ঘ্রাণ ফুসফুসে গিয়ে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

এ কাজে জড়িত কৃষকদের পাশাপাশি শিশু ও নারীদেরও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। তামাকের ক্ষতিকারক নিকোটিন পদার্থ তামাক শুকানোর সময় মানুষের দেহের ও শরীরের ক্ষতি করে থাকে।

তিনি আরও বলেন, ঘর-বাড়ি, রাস্তার পাশ ও বাগানে বিচ্ছিন্নভাবে রশিতে ঝুলিয়ে তামাক শুকানোর কারণে আশেপাশের অনেকেই এর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন।