এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) : কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে কৃষক পরিবারের ঐতিহ্য ‘গোলা’। ধান, চাল, গম সংরক্ষণের বড় পাত্র বাঁশের তৈরি গোলা। বাঁশ দিয়ে এ গোলা তৈরি করা হয়। গ্রামের কৃষক পরিবার গোলায় ধান সংরক্ষণ করে থাকেন। সারাবছর ধান সংরক্ষণ করতে গোলা খুবই উপযোগী। ধানের মৌসুমে ধান কেটে শুকিয়ে গোলাজাত করা হয়। প্রয়োজনের সময় গোলা থেকে ধান বের করে পুনরায় রোদে শুকিয়ে ধান ভাঙানো হয়।
মিরসরাই উপজেলার গ্রামাঞ্চলে এখন আর আগের মতো চোখে পড়েনা গোলা । কালের বিবর্তনে হারিয়ে প্লাষ্টিকের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্য। ধান মাড়াইয়ের পর গোটা বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখার যে গোলা আজ তা হারিয়ে যেতে বসেছে। যুগের হাওয়া পাল্টেছে, পাল্টেছে সারা বছরের জন্য ধান রাখার ধরণ। দু’চার জন বড় গৃহস্থ ছাড়া ছোটো- খাটো কৃষকরা এখন আর সেভাবে ধান মজুদ রাখতে পারেন না।
খাওয়া-সাংসারিক খরচ মিটিয়ে যে সামান্য ধান থাকে তা কেউ বস্তায় কেউবা অন্য বাসন-কোসনেই রেখে দেন তা। ফলে এক সময়কার কৃষকদের অতি প্রয়োজনীয় ধানের গোলা এখন সচরাচর চোখেই পড়ে না।
উপজেলার মধ্যম ওয়াহেদপুর এলাকার সত্তরোর্ধ এরশাদ উল্লাহ বলেন, একসময় গোলা ভর্তি ধান না থাকলে গ্রামের কৃষক পরিবার সেই বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে পর্যন্ত দিতে আগ্রহী হতেন না। এখন পুরো এলাকায় খুঁজে একটি পরিবারেও গোলা যাওয়া যাবেনা।
জানা গেছে, গোলায় ধান রেখে সেই গোলার মুখ মাটি দিয়ে লেপে দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়। আবার টাকার প্রয়োজন হলে গোলা থেকে ধান বের করে বাজারে বা পাইকারের কাছে বিক্রি করা হত। সে সময়ে সমাজ ব্যবস্থা এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না।
তখন চোর- ডাকাতের ভয়ে গোলার ধানের ভেতর স্বর্ণ ও টাকা-পয়সা লুকিয়ে রাখা হতো। ধান রাখার এ পাত্রকে গোলা বা ডোল আখ্যায়িত করার কারণও রয়েছে। গোলা অপেক্ষাকৃত মজবুত। দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। বাঁশের তৈরি গোলার ব্যবহার দিনদিন কমে যাচ্ছে। কারণ বাঁশ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।
গ্রাম এলাকায় বেশিরভাগ স্থাপনা পাকা ও টিনের গড়ে উঠায় এই বাঁশের চাহিদাও কমছে। এ কারণে বাঁশের আবাদও কমে যাচ্ছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং বাঁশের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গোলা তৈরিতেও খরচ বেড়ে গেছে।
গোলায় ধান সংরক্ষণ করলে ইঁদুর ধান নষ্ট করে বেশি। ইঁদুরের হাত থেকে ধান রক্ষার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে গোলার ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। বাঁশের তৈরি গোলার স্থান দখল করে নিয়েছে স্থায়ী পাকা অথবা টিনের গোলা। এই গোলা বাইরে রাখা যায় বলে ঘরের জায়গা খোলামেলা থাকে
তারপরেও ছোট্ট ছোট কৃষকরা হাটবাজার থেকে একটি বড় গোলা ১৫ শ’ থেকে ১৮শ’ ও একটি ছোট গোলা ৮শ’ থেকে ১২ শ টাকায় কিনে বাড়িতেই ধান সংরক্ষণ করছেন।
নাট্যকার ও সংস্কৃতি কর্মী মঈন উদ্দিন আহমেদ সেলিম বলেন, গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ হারিয়ে গেছে। গ্রাম বাংলার কৃষক পরিবারের সেই ধানের গোলা এখন প্রায় বিলুপ্ত। আমাদের উচিৎ এই ঐতিহ্য ধরে রাখা।