এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) : মহান মুক্তিযুদ্ধে উপজেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। মুক্তিযুদ্ধে গ্রামে গ্রামে চলেছে নৃশংস হত্যা, ধর্ষণ আর অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। এখানকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও দীর্ঘ। ইতিহাসে উল্লিখিত এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু সম্মুখযুদ্ধে এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ১২ খন্ডের দলিলেও বিষয়টির উল্লে¬খ রয়েছে। অথচ এখানকার বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো অরক্ষিত পড়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্মৃতিবিজড়িত স্থান ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওসি মিয়ার পুল। যা ২০১৬ সালে চার লেন স¤প্রসারণ প্রকল্পের তলায় চাপা পড়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারা আপ্রাণ চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি মুুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিস্মারক। শুধু তাই নয়, ওসিমিয়ার পুল এলাকায় মিরসরাই উপজেলার সকল মুক্তিযোদ্ধার ছবি ও নাম সংবলিত একটি স্মৃতিফলক নির্মাণাধীন অবস্থায় ভেঙে ফেলা হয়েছে। ওই এলাকায় পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান, ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া ও সাব সেক্টর কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এ স্থানে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে গণকবর দেওয়া হলেও সেসব বধ্যভূমিগুলো রয়েছে এখনো অরক্ষিত। উপজেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের পক্ষ থেকেও এ যাবত কোনো উল্লে¬খযোগ্য তৎপরতা চোখে পড়েনি।
সংশ্লি¬ষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি মিরসরাইয়ে মাইক্রোফোনের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। এখানকার প্রায় চার হাজারেরও বেশি মানুষ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। মিরসরাই ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মিরসরাইয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে শহীদ হন ৪২ মুক্তিযোদ্ধা এবং নাম না জানা আরো অনেকে। এছাড়া মিরসরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধকালীন সময়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে গণকবর দেওয়া হয়।
জানা গেছে, উপজেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিটি হচ্ছে মিরসরাই রেলস্টেশন সড়কের লোহারপুল এলাকায়। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এই বৃহত্তম বধ্যভূমি এলাকায় চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের উদ্যোগে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। বর্তমানে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিরসরাই রেলস্টেশনের লোহার পুল। এখানে হানাদাররা মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে লাইন দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে নৃশংসভাবে হত্যা করত। পরে নিচের খালে ভাসিয়ে দেওয়া হতো নিরীহ গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ। এছাড়া এই পুলের নিচে ভাসিয়ে দেওয়া হতো হানাদার ও রাজাকারদের হাতে ধর্ষিতা নারীদের।
এ ছাড়া করেরহাটের পাহাড়িয়া লোহারপুল, করেরহাটের ফেনী নদীর পার, হিঙ্গুলী সেতু সংলগ্ন, মিরসরাই সদরের অছি মিয়ার পুল, হিঙ্গুলী কোর্টের পাড়, ছুটি খাঁ দিঘির পাড়, মস্তাননগর হাসপাতাল, ঝুলনপোলসহ অর্ধশতাধিক স্থানে নিরীহ মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়। মিরসরাই রেলস্টেশন এলাকার একটি জমিতে শতাধিক লোককে একই স্থানে কবর দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭২ সালের ৩ মে উপজেলার ২ নম্বর হিঙ্গুলী ইউনিয়নের পশ্চিম হিঙ্গুলী গ্রামে জঙ্গলঘেরা একটি অন্ধকার পুকুরে ৮৩টি নরকঙ্কাল পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, সাধারণ মানুষকে হত্যার পর ওই পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। শত্রুবাহিনীর আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পেতে মুক্তিযোদ্ধারা ফেনী নদীর উপর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল সড়কের দক্ষিণাংশ ধ্বংস করে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে শত্রুবাহিনী। ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানের প্রায় ২৪০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে ফেনী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, এমন কোনো দিন ছিল না এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেনি। পরবর্তীতে ওই স্থানটিও বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক শুভপুর ব্রীজের দুই পাশে এবং ব্রীজের মাঝখানে বহু লোককে পাকবাহিনী হত্যা করে ফেনী নদীতে ফেলে দিত। হিঙ্গুলী ব্রীজের উত্তর পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন একটি বধ্যভূমি রয়েছে। এখানেও বহু লোককে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তাঁদের হাড়, মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল।
জানা যায়, হিঙ্গুলী ব্রীজের উত্তর পাশের বধ্যভূমিতে নুরুল হুদা মেম্বার, মিয়া সওদাগর, মুন্সি মিয়া, আমিন মিয়া, আবু তাহের, আবুল কালাম ও তাঁর ভাই সিদ্দিক আহম্মদ, মকবুল আহম্মদ, সাবিদ আলী, খায়েজ আহম্মদ, নুর আহম্মদ, হোরা মিয়া, দলিলুর রহমান, সিদ্দিক আহম্মদ, উপেন্দ্র বাবুসহ অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হানাদার বাহিনী হত্যা করে। পার্শ্ববর্তী হিঙ্গুলী কোর্টের পাড় ও জামালপুর বধ্যভূমিতে অর্ধশতাধিক লোককে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়।
হিঙ্গুলী ব্রীজ সংলগ্ন বধ্যভূমিটিতে একটি অংশে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এম এ কামাল পাশা এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের অসচেতনতায় স্মৃতিস্তম্ভটি মর্যাদা হারাতে বসেছে। বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভটি বর্তমানে অরক্ষিত হয়ে পড়ে রয়েছে।
জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ছুটি খাঁ দিঘির দক্ষিণ পূর্ব কোণে ছিল বধ্যভূমি। সেখানে নাম না জানা বহু লোককে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চলাচলরত বাসসহ অন্যান্য যানবাহন থেকে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করে ছুটি খাঁ দিঘির পাড়ে ফেলে দেওয়া হত। মস্তাননগর হাসপাতালের পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন একটি বধ্যভূমি রয়েছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, শতাধিক মানুষকে ধরে এনে বিভিন্ন সময় পাকবাহিনী ও রাজাকাররা হত্যা করে। ঝুলনপোলের পশ্চিম পাশের বধ্যভূমিতেও বাঙালিদের লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল। মিরসরাই সদর ইউনিয়নের তালবাড়িয়া বধ্যভূমিতেও পাকবাহিনী বহু বাঙালির লাশ ফেলে রাখত।
কাটাছড়া ইউনিয়নের তেমুহানী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী প্রজন্মের জন্য ইতিহাস হিসেবে শেষ চিহ্ন বধ্যভূমি। তাই বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া এখনই জরুরি।’ মিরসরাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবুল হাশিম বলেন, ‘বধ্যভূমিগুলো আমাদের স্বাধীনতার স্মৃতির উপকরণ। সুতরাং এখনই এগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া একান্ত অত্যাবশ্যকীয় কাজ।’
মিরসরাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার কবির আহম্মদ জানান, ‘চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ বরাবরে একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা যাবে। যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে গেছেন তাঁদের শেষ স্মৃতিটুকু রক্ষা করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।’