এশিয়ান পেইন্টস, নিপ্পন-ম্যাকডোনাল্ড উৎপাদনে
আগামী বছরে উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা করছে সমুদা ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড, মডার্ন সিনটেক্সসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান
এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) : চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে কারখানায় উৎপাদন শুরু করেছে দুটি প্রতিষ্ঠান। আগামী বছরের মধ্যে উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা করছে সমুদা ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড, মডার্ন সিনটেক্স সহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে উৎপাদন শুরু করেছে এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড ও মার্চ থেকে উৎপাদন শুরু করেছে জাপানের নিপ্পন স্টিল কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশের ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রোডাক্ট। প্রতিষ্ঠান দুটির উৎপাদিত পণ্য দেশে বাজারজাত করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মিরসরাই উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ছিলো বছরের পর বছর পতিত জমি। সাগরের নোনা জলের সংস্পর্ষে সেখানে ফলতো না ফসল। শুধুমাত্র গরু মহিষের চারণভ‚মি হিসেবে ব্যবহার হতো এসব বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। কালের পরিক্রমায় সে অনাবাদি পতিত জমিতে গড়ে উঠছে শিল্পাঞ্চল। চট্টগ্রামের মিরসরাই, ফেনীর সোনাগাজী ও সীতাকুন্ডের ৩০ হাজার একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এ শিল্পনগরীর নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর।
দেশের ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর হবে পরিবেশ সহনশীল গ্রিন অর্থনৈতিক অঞ্চল। এজন্য বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (সিইটিপি), ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট, স্টিম নেটওয়ার্ক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, ওয়েস্ট সোর্টিং ফ্যাসিলিটি, রুফটপ ও ফ্লোটিং সোলার স্থাপনসহ উপক‚লীয় অঞ্চলে বৃক্ষরোপণসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সহকারী প্রকৌশলী ফেরদৌস ওয়াহিদ জানান, বর্তমানে এশিয়ান পেইন্টস এবং ম্যাকডোনাল্ড স্টিল উৎপাদনে রয়েছে। এশিয়ান পেইন্টস রং এবং ম্যাকডোনাল্ড স্টিল উৎপাদন করছে স্টিল শিট। প্রতিষ্ঠান দুটির উৎপাদিত পণ্য দেশে বাজারজাত করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত দুইশ’রও বেশি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। এদের সঙ্গে ২২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। আরও বিনিয়োগ-শিল্পায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, ভারত, অষ্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিদেশি এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে আকৃষ্ট করেছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে সরাসরি শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), বেসরকারি উদ্যোগ এবং যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব অব্যাহত আছে। শিল্পোদ্যোক্তা-বিনিয়োগকারীরা একক অথবা যৌথ উদ্যোগে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ও নীটওয়্যার, ইস্পাত ও লোহাজাত শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, পাটজাত শিল্প, চামড়া শিল্প, রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও মেলামাইন, স্পোর্টস সামগ্রী, খেলনা, সাইকেল, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম, ওষুধ, মেডিকেল সামগ্রী, কন্টেইনার ম্যানুফ্যাকচারিং, ভোজ্যতেল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, মোটরযান ও অটোমোবাইল, আইটি, বিভিন্ন সেবাখাতের পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের উপযোগী শিল্প-কারখানা স্থাপন করছে।
বিনিয়োগ আগ্রহ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিব শিল্পনগরে জমি বরাদ্দ পেয়েছে, উত্তরা মোটরস, বার্জার পেইন্টস, বেইজিং ঝেনুয়ান হেংহুই ইঞ্জিনিয়ারিং কনসাল্টিং কোম্পানি, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি, বিএসএ ফ্যাশনস লিমিটেড, হাংঝু ঝিনঝিয়াং গ্রুপ, ঝিন্দে ইলাস্টিক (বিডি), এক্সপোর্ট কম্পেটিটিভনেস ফর জবস, ইস্ট এশিয়ান কক্স, কমফিট কম্পোজিট নিট, ইওন মেটাল ইন্টারন্যাশনাল, ট্রেড ডিজাইন সল্যুশনস, ইয়নমেটাল লিমিটেড, ফন ইন্টারন্যাশনাল ও আরব বাংলাদেশ ফুডস লিমিটেড। এ ছাড়া বরাদ্দ পেয়েছে গ্যাস ওয়ান লিমিটেড, অনন্ত অ্যাপারেলস লিমিটেড, বিপি-পাওয়ারজেন লিমিটেড, এসিআই লিমিটেড, ইনট্রিগা অ্যাপারেলস লিমিটেড, হ্যামকো করপোরেশন লিমিটেড, যমুনা স্পেসটেক (জেভি) লিমিটেড, বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেড, চিটাগং পাওয়ারসহ অনেক প্রতিষ্ঠান।
এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের মহা ব্যবস্থাপক বোধাদিত্য মুখার্জি জানান, আমরা চলতি বছরের এপ্রিল মাসে কমার্শিয়াল সার্টিফিকেট পাই। আর সে মাসেই উৎপাদন শুরু করেছি। আমাদের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২৫০০০ টন। আমরা আশাবাদী যে শীঘ্রই পূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করতে পারব। তিনি আরো আরও জানান, শিল্পনগরে তাদের কারখানাটির সব ধরনের ডেকোরেটিভ পেইন্টস এবং নির্মাণকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
এদিকে জাপানের নিপ্পন স্টিল কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশের ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রোডক্টের যৌথ উদ্যোগে ১০ একর জমিতে ১১৪ কোটি টাকা বিনিয়োগে স্টিল কারখানা স্থাপন করে। গত ২৫ জানুয়ারি তারা কারখানায় পরীক্ষামূলক উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে।
ম্যাকডোনান্ড স্টিলের প্রজেক্ট ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে ২০ টন স্টিলের প্রথম চালান সরবরাহ করে ম্যাকডোনান্ড স্টিল। এরপর থেকে উৎপাদন অব্যাহত আছে। এই কারখানায় এমএস প্লেট তৈরী হচ্ছে।
এছাড়া ২০২৩ সালের মধ্যে উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা করছে সমুদা ফুডস, মডার্ন সিনটেক্স সহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
গত মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎপাদন কার্যক্রম উদ্বোধনের কথা জানিয়েছিলো বেজা।
বেজার তথ্য মতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের ৩০ হাজার একর জমির মধ্যে প্রায় ৬ হাজার একর জমি শিল্পকারখানা গড়ে তোলার উপযোগী করা হচ্ছে। অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে এই ৬ হাজার একর জায়গাজুড়ে রাস্তা, ব্রিজ, বিদুৎ, গ্যাস সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে ৫০০ একর জায়গায় গড়ে উঠছে গার্মেন্টস ভিলেজ। ১ হাজার ১৫০ একর জমিতে গড়ে উঠছে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল। এছাড়াও ৫০০ একর বসুন্ধরা গ্রæপকে এবং ৫০০ একর এসবিজি ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠার জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে চলেছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ।
এছাড়া ৪০ একর জমিতে হেলথ কেয়ার, ১০০ একর জমিতে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ, ৪০ একর জমিতে এসকিউ ক্যাবল, ১০ একর জমিতে চীনের জিং জিয়ান, ২০ একর জমিতে মডার্ন সিনটেক্স এবং ১০০ একর জমিতে নিপ্পন ও ম্যাকডোনাল্ড সহ কয়েকটি কারখানার কাজ চলছে।
বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালক কামরুল ইসলাম খান বলেন, বিশ্বে পরিবেশ যখন দূষণের শেষ পর্যায়ে, তখন বিশ্বে বিভিন্ন উন্নত দেশ বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার করছে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশে সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির কারখানা করছে অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। আগামী বছরের মাঝামাঝি বাংলাদেশি ব্র্যান্ড নামে বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারে আনবেন বলে আশা প্রকাশ করে এটাও বলেন, আগামীতে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে চিনবে এ গাড়ি উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে।
চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের গুরুত্ব অপরিসীম। এর যেসব অবকাঠামো এখনও অসম্পন্ন রয়েছে সেই যাবতীয় অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা জরুরী সম্পন্ন করা প্রয়োজন। পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন ও বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হলে এটি বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হবে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি বলেন, মিরসরাইয়ের চরাঞ্চলে জেগে উঠা হাজার হাজার একর পতিত জমিতে কিভাবে শিল্পায়ন করা যায় কিনা এজন্য আমি সর্বপ্রথম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রোপাইল তৈরি করে দেখিয়েছি। কারণ সারা বাংলাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে যে পরিমাণ জায়গা রয়েছে তার চেয়ে বেশি জায়গা রয়েছে এই চরাঞ্চলে। এরপর প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দেন। পরে এখানে শিল্পনগর গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এটি এখন এশিয়ার মধ্যে অন্যতম শিল্পাঞ্চল। আধুনিক এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পাঞ্চলে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অনতিদূরে এ জনপদ হবে শিল্পশহর। তিনি আরো বলেন, এই শিল্পনগর গড়ে তুলতে আমার এলাকার মানুষ সহযোগিতা করেছি। এখানকার মানুষ সহযোগিতা না করলে শিল্পনগর গড়ে তোলা সম্ভব হতো না। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একাধিকবার বলেছি, জাতীয় সংসদেও দাবী তুলেছি আমার এলাকার বেকার মানুষ যেন এখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকুরী পায়।