বিপুল মিয়া, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি : আকলিমা বেগম (৪০) বিয়ে হয়েছে ২০ বছর আগে, তিনি তিন সন্তানের জননী। আকলিমার বেগমের বাড়ী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের চরপেচাই গ্রামে। তিনি ওই এলাকার তহিদুল ইসলামের স্ত্রী। স্বামী তহিদুল দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালালেও অভাব তাদের নিত্য সঙ্গী।
অভাবের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায় সময় ঝগড়া বিবাদ চলতো। এক সময় স্বামী তহিদুল ইসলাম স্ত্রী আকলিমা ও তিন সন্তান অভাবের তাড়নায় দিধাদ্বন্দ ক্রমশ বাড়তে থাকে। তারপরেও স্ত্রী আকলিমা স্বামীর কথায় তেমন কিছু মনে করতেন না।
অভাবের সংসারে তিন সন্তানকে মানুষ করার লক্ষ্যে সমস্ত দোষ শিকার করেই চলতো আকলিমা। কিন্তু স্ত্রী-সন্তানের মায়া ত্যাগ করে অন্য জায়গায় গিয়ে নতুন করে সংসার পাতেন স্বামী তহিদুল। টানা ৬ মাস স্বামী তহিদুলের পথ চেয়ে থাকলেও তিনি স্ত্রী আকলিমা ও সন্তানদের খোঁজ খবর নেয়নি। এভাবেই ৫টি বছর অতিক্রম করলেও একটি বারের জন্য স্ত্রী আকলিমা ও তিন সন্তানের খোঁজ রাখেনি স্বামী তহিদুল। এরপর আকলিমা স্বামীর ভিটা ছেড়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে তিন সন্তানকে নিয়ে একই এলাকার ভাই শহিদুলের বাড়ীতে আসেন।
স্বামী তহিদুলের আশা ছেড়ে তিন সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে জীবন যুদ্ধে নামিয়ে পড়েন আকলিমা। কিছুদিন ভাইয়ের বাড়ীতে থেকে তিন সন্তানকে মানুষ করার লক্ষ্যে আকলিমা বেগম কৃষি কাজে মনোযোগ দেন।
এভাবেই আকলিমা বেগম ভাইয়ের সহযোগীতায় চরপেচাই এলাকায় মানুষের জমি লিজ (কন্ট্রাক) নিয়ে বাদাম, ভুট্টা ও ধানের চাষাবাদ করে তিন সন্তানকে নিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন।
আকলিমার বড় ছেলে রায়হান (১৮) সংসারে অভাব থাকায় ৭ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ালেখা করেই সমপ্তি ঘটে। এর পর বড় ছেলে রায়হান মা আকলিমার সাথে ক্ষেতে কাজ-কামের সহযোগী করে। দ্বিতীয় ছেলে রাকিবুল হাসান ৫ম শ্রেনী ও ছোট মেয়ে শিশু ওয়ানে পড়েন।
আকলিমা বেগম এ বছর বাদাম দেড় বিঘা ও ধান দেড় বিঘা চাষাবাদ করেছে। এ ভাবে তিনি মানুষের জমি লিজ নিয়ে গত ৫ বছর ধরে সন্তানের ভরণপোষন ও পড়ালেখার খরচ চালিয়ে অনেকটা স্বচ্ছল ভাবে জীবন নির্বাহ করে আসছেন। পুরুষ চাষিদের সাথে পাল্লা দিয়ে একজন নারী হয়ে তিনি গত ৫ বছর ধরে বাদাম, ভুট্টা ও ধানের চাষাবাদ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। জীবন-যুদ্ধে তিনি একজন সংগ্রামী নারী।
এ বছর আবহাওয়া অনুকুল থাকায় আকলিমা বেগমের বাদাম ও ধানের ফলন ভালই দেখা যাচ্ছে। আকলিমা বেগমের বাদাম খেত দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। শুধু বাদাম নয় আমন ধানের খেত দেখলেও নয়ন জুড়িয়ে যায়। উপজেলা বিভিন্ন চরাঞ্চলে শতশত বিঘায় বাদাম চাষ করেছেন চাষিরা। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় এ বছর বাদামের ভাল ফলন আসবে বলে চাষিরা আশা করছেন।
আকলিমা বেগম জানান, আমার স্বামী ৫ বছর ধরে কোন খোঁজ খবর রাখেনি। আমার তিন সন্তান। বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে লড়াই সংগ্রাম করেই দুই ছেলে ও ১ মেয়েসহ কিছু জমাতে না পারলেও স্বচ্ছল ভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছি। এক দিকে স্বামী থেকেও নেই, অন্য দিকে অভাবের কারণে বড় ছেলের পড়া বন্ধ হয়েছে। তাই বড় ছেলেসহ আমি খেতে কাজ-কাম করে ছোট ছেলে ও মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন আমি যেন দুই সন্তানের পড়াশুনা করে মানুষের মত মানুষ করতে পারি।
আকলিমা আরও জানান, এখন আমার স্বামী না আসলেও কোন সমস্যা নেই। জায়গা জমি না থাকলেও ভাইয়েরা আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সব সময় ভাইয়েরা খোঁজ খবর নেন। কৃষি কাজেও ভাইয়েরা অনেক সহযোগীতা করেন। আমি এভাবেই আজীবন কৃষি কাজ করে তিন সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। তিনি উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষি কাজের সব ধরণের সহযোগীতার জন্য সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন।
আকলিমার ভাই ফজর আলী জানান, আমার ছোট বোন আকলিমা খুবই পরিশ্রমী। তিন চার বিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলান। কোন প্রকার মজুরী নেন না। সব কাজই সে নিজেই করে। মাঝে মধ্যে তার বড় ছেলে একটু সহযোগীতা করেন। কৃষি কাজের উপর তিন সন্তানকে নিয়ে জীবন নির্বাহ করছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি হাস, মুরগী ও ছাগলও লালন পালনও করেন। এভাবেই মাঠে ময়দানে লড়াই সংগ্রাম করেই যাচ্ছে আকলিমা। আমি তার উত্তর উত্তর সাফল্য কামনা করি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াছমিন জানান, আকলিমার মতো নারীরা কৃষি কাজে এগিয়ে আসলে কৃষিতে আমূল পরিবর্তন আসবে। সেই সাথে কৃষি প্রধান দেশ হিসাবে নারীদের যেমন কৃষির উপর আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে বাড়বে কৃষি উৎপাদনশীলতাও। কৃষি বিভাগ থেকে আকলিমাকে প্রয়োজনীয় সব ধরণের সহায়তা দেয়া হবে। এ বছর চলতি মৌসুমে ৫ হেক্টর জমিতে চাষিরা বাদামের চাষাবাদ করেছে।