রায়ের বাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধ প্রাঙ্গণ। ছবি: ইন্টারনেট

খোলাবার্তা২৪ ডেস্ক : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে দেশের শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পেশাজীবীদের টার্গেট করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের স্মরণে প্রতি বছর ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু দিবস থাকলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রীয় কোন তালিকা নেই।

স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরে সরকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৩ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এতে ১২২২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজ প্রথমে ১৯৭২ সালে শুরু হলেও, সে তালিকা কখনো সরকারি নথি বা গেজেটভুক্ত হয়নি। এখন যে ১২২২ জনের প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, সেটি গেজেটভুক্ত করা হবে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির জন্য চলতি বছরের ১৯শে নভেম্বর একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির একজন সদস্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেছেন, ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল।

“এরপর ডাক মন্ত্রণালয় থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ডাকটিকেট বের করা হয়েছে। এরপর আরো নতুন নাম যুক্ত করে বাংলা একাডেমীর একটা গবেষণা আছে। এই সব মিলিয়ে সরকারিভাবে যাদের সম্মাননা বা স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সেগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে।”

“এই তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়। আমরা ঠিক করেছি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যাতে একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা যায়। এক বছরের মধ্যে সেটা শেষ করবো বলে আমরা আশা করছি,” বলছেন শাহরিয়ার কবির।

শাহরিয়ার কবির বলেছেন, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সব জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজে প্রথমবারের মত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের মধ্যে কতজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তার সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায় না। যাদের নাম জানা যায়, তাদের মধ্যেও শহরকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাই বেশি।

১৯৭২ সালে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা করেছিল তৎকালীন সরকার। পরে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৫২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর ডাকটিকেট প্রকাশ করে।

সরকারের তৈরি করা শহীদ বুদ্ধিজীবীর নতুন তালিকা এই দুইটি হিসাবের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে। এর বাইরে বাংলা একাডেমী প্রণীত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গবেষণা গ্রন্থেও আরো বুদ্ধিজীবীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা কী হবে?

শাহরিয়ার কবির বলেছেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নির্ধারণে বাংলা একাডেমী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করেছিল। সেই কমিটির নির্ধারিত সংজ্ঞাকেই প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যেখানে কয়েকটি পেশা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারাই বুদ্ধিজীবী।

এদিকে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক বিবিসিকে বলেছেন, কারা শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় জায়গা পাবেন, তা নিয়ে কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি। ১৯শে নভেম্বর গঠিত হবার পর কয়েকটি বৈঠক হয়েছে, এবং সেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা হলেও এখনো সেটি চূড়ান্ত হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, “কাদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচনা করা যাবে তার একটা মাপকাঠি থাকা উচিত, একটা সংজ্ঞা থাকা উচিত। গত মিটিংয়ে আমরা একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছি, সেটা এলোমেলোভাবে লেখা হয়েছে, আগামী মিটিংয়ে সেটা গুছিয়ে পেশ করা হবে। এই সংজ্ঞা অনুমোদন হবার পর বাকি যেসব আবেদন আসবে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়া হবে।”

তিনি বলেছেন, “শিল্পী, সাহিত্যিক, ডাক্তার এবং বিভিন্ন পেশাজীবী—যারা মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন, তারাই আসবেন তালিকায়।”

কিভাবে হবে এই তালিকাভুক্তি?

শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। এরপর সরকারি কমিটি সেসব নাম, পিতার নাম, ঠিকানা এবং প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি যাচাই-বাছাই করে দেখবে। কিন্তু সেই যাচাই-বাছাই কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।

কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পর অনেক তথ্য প্রমাণ নষ্ট হয়ে গেছে, অনেক পরিবারের স্বজনেরা বেঁচে নেই, বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন অনেকে। ফলে প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা খুবই কঠিন বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের অনেকে।

কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবী আব্দুল আলীম চৌধুরীর কন্যা অধ্যাপক নুজহাত চৌধুরী মনে করেন, তালিকা প্রণয়ন ও যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কাজে লাগাতে পারলে, সেটি সুচারুভাবে করা সম্ভব।

“একটা ইউনিয়ন হিসেবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, একটা ইউনিয়নে কে মুক্তিযোদ্ধা ছিল, কে রাজাকার ছিল বা কে শহীদ হয়েছে সেটা সেখানকার সবাই জানে। পাঁচ দশক পরে পূর্ণাঙ্গভাবে এই তালিকা করা কঠিন আমি জানি।

”কিন্তু ত্রাণ দেয়া বা টিকা দেয়ার সময় স্থানীয় সরকারকে কাজে লাগিয়ে যদি সব মানুষকে দেয়া যায়, তাহলে সেই একই নেটওয়ার্ককে সৎভাবে কাজে লাগিয়ে এই তালিকা কেন করা যাবে না?” তিনি বলেন।

সরকার বলছে এক বছরের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে। সেক্ষেত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য সময়কাল ধরা হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। – বিবিসি অবলম্বনে