খোলাবার্তা২৪ ডেস্ক : খাদ্যরসিক বা ভোজন রসিক! অনেকেই আছেন যারা নামকরা কোনো হোটেল-রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যান। খাবারের ঐতিহ্যের কথা বলতে পুরান ঢাকার কথা সবার আগে চলে আসে। পুরান ঢাকার অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে এমন দারুণ সব খাবার৷ কাচ্চি বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, পুরি, কাবাব, বাকরখানিসহ অনেক জনপ্রিয় খাবারের ঠিকানাই পুরান ঢাকা৷
হাজী বিরিয়ানি : পুরান ঢাকায় বিরিয়ানি দারুণ জনপ্রিয়৷ উপরের সারিতেই মোঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী হাজী বিরিয়ানি৷১৯৩৯ সালে হাজী মোহাম্মদ হোসেন প্রতিষ্ঠা করেন৷ বংশপরম্পরায় তার নাতিরা এখন ব্যবসা দেখছেন৷খাসির মাংস দিয়ে অপূর্ব রন্ধনশৈলী মানেই হাজী বিরিয়ানি৷ প্রতি প্লেট ২০০ টাকা (হাফ)৷ নাজিরা বাজারের কাজি আলাউদ্দিন রোডে ৭০ নম্বর দোকানটি খোলা থাকে সকাল ১১টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত৷
নান্নার মোরগ পোলাও : হাজী নান্না বিরিয়ানির মোরগ পোলাও ভোজনরসিকদের খুব প্রিয়৷ পুরান ঢাকার বাবুর্চি হাজী নান্না মিয়া ১৯৬২ সালে শুরু করেন এই ব্যবসা৷ পরিবারের সদস্যরা সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন৷ নান্নার মোরগ পোলাও প্রতি প্লেট ১৫০ টাকা (হাফ)৷ এছাড়া আছে খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি৷ এখানে প্রতি মাসের ৫ তারিখে গোটা মোরগের কাচ্চি বিক্রি হয়৷ বেচারাম দেউড়িতে ৪১ নম্বর দোকানটি প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে৷
হানিফ বিরিয়ানি : বহু বছর ধরে স্বাদ, মান ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে হানিফ বিরিয়ানি৷ এটি যাত্রা শুরু করে ১৯৭৫ সালে৷ পুরান ঢাকার বাসিন্দা হাজি মোহাম্মদ হানিফ এটির প্রতিষ্ঠাতা৷ ২০০৫ সালে তার মৃত্যুর পর ছেলে হাজি মোহাম্মদ ইব্রাহিম রনি ব্যবসার হাল ধরেন৷ এখানকার প্রধান আকর্ষণ খাসির বিরিয়ানি৷ নাজিরা বাজারের কাজি আলাউদ্দিন রোডে ৩০ নম্বর দোকানটিতে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বিরিয়ানিপ্রেমীদের ভিড় চোখে পড়বেই৷
ঝুনুর মোরগ পোলাও : দেশি মোরগ দিয়ে রান্না হয় মজাদার ঝুনুর পোলাও৷ এটি পুরান ঢাকার অত্যন্ত জনপ্রিয় পদ৷ হাফ প্লেট মোরগ পোলাও ১৭৫ টাকা, ফুল প্লেট ৩৬০ টাকা৷ এতে থাকে এক টুকরো মাংস, একটি ডিম, মুরগির গিলা-কলিজা-মাথা ভুনা৷ নারিন্দা রোডের ১১ নম্বরে ঝুনু পোলাও ঘর৷ ১৯৭০ সালে নূর মোহাম্মদ তার মেয়ে ঝুনুর নামে দোকানের নাম রাখেন৷ প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এখানে বেচাকেনা চলে
নীরব হোটেলের ভর্তা-ভাজি : ভর্তা-ভাজির কথা বললেই জিভে জল আসে৷ নাজিমউদ্দিন রোডের ১১৪ নম্বরে নীরব হোটেলের তাই আলাদা সুখ্যাতি আছে৷ দুপুর ও রাতে ২০-২৫ পদের ভর্তা-ভাজির পসরা বসে এখানে৷ নীরব হোটেল তাই সরব থাকে দিনভর৷ ভর্তা-ভাজি দিয়ে পেট পুরে খাওয়া যায়৷ এছাড়া মাংসের কালাভুনা ও মগজ ভুনা জনপ্রিয়৷ দোকানটি খোলা থাকে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত৷
বুদ্দুর খাসির কাচ্চি : বাসমতি চাল দিয়ে রান্না করা বুদ্দুর খাসির কাচ্চি বেশ লোভনীয়৷ হাফ প্লেটের দাম ১৫০ টাকা, ফুল প্লেটের দাম ২৫০ টাকা৷ ১৯৫৯ সালে বিরিয়ানির ব্যবসা শুরু করেন বুদ্দু মিয়া৷ তার ছেলে হাজী মোহাম্মদ রানা এখন ব্যবসা দেখভাল করছেন৷ বুদ্দু বিরিয়ানি হাউজে খাসির কাচ্চির পাশাপাশি মোরগ পোলাও জনপ্রিয়৷ ফরিদাবাদের হরিচরণ রায় রোডে ৫৬ নম্বর দোকানটিতে বেচাকেনা হয় সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত৷
বিউটি লাচ্ছি : ঐতিহ্যবাহী বিউটি লাচ্ছির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯২২ সালে৷ এটির প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ৷ আগামী জুনে শতবর্ষের মাইলফলক স্পর্শ করবে দোকানটি৷ বর্তমানে আজিজের দুই নাতি পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য সুনামের সঙ্গে ধরে রেখেছেন৷ ৩০/১ জনসন রোডে অবস্থিত বিউটি লাচ্ছি-ফালুদা৷ লাচ্ছি প্রতি গ্লাস ৪০ টাকা, ফালুদা ৭০ থেকে ৯০ টাকা৷ দোকানটি খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত৷
বিসমিল্লাহ কাবাব ঘর : ঐতিহ্যবাহী কাবাবের জন্য ভোজনরসিকদের কাছে অনন্য বিসমিল্লাহ কাবাব ঘর৷ নাজিরা বাজারের কাজি আলাউদ্দিন রোডে অবস্থিত এই দোকানে আছে গরুর মাংসের চাপ, গরুর বটি কাবাব, মুরগির পায়ের চাপ ও ব্রেস্ট চাপ, খাসির গুর্দা কাবাব, গরু ও খাসির খিরি কাবাব ও মগজ ফ্রাই৷ এগুলির দাম ৯০ থেকে ১৪০ টাকা৷ ১৯৮৭ সালে দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন মো. খোরশেদ৷ তার মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন বড় ছেলে হাবিবুর রহমান৷
বুদ্দুর পুরি : স্বাদ ও ঘ্রাণের দিক দিয়ে বুদ্দুর পুরি অতুলনীয়৷ ১৯৫০ সালে সূত্রাপুরের ডালপট্টিতে প্রতিষ্ঠিত বুদ্দুর হোটেলে এখন প্রতিদিন আড়াই হাজারের বেশি পুরি তৈরি হয়৷ এজন্য লাগে মণখানেক আটা৷ এখানকার বিশেষ পদ ডিম পুরি৷ বুদ্দুর নামকরা ডালপুরির দাম ৫ টাকা, ডিমপুরি ২০ টাকা৷ হেমন্ত দাস রোডে ৩৫ নম্বর দোকানটি প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে সকাল ১১টা এবং বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে৷
ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি : মোগল আমলের প্রসিদ্ধ খাবার বাকরখানি৷ উত্তাপ ছড়ানো জ্বলন্ত কয়লায় ময়দা দিয়ে তৈরি হয় বাকরখানি৷ জনশ্রুতি আছে, জমিদার আগা বাকের ও তার প্রেয়সী মুর্শিদাবাদের নর্তকি খনি বেগমের নাম মিলিয়ে এর নামকরণ হয়৷ লালবাগ কেল্লার কাছে প্রথম বাকরখানি বিক্রি হতো৷ পুরান ঢাকার ছোট-বড় সব গলিতে এসব দোকান চোখে পড়ে৷ এগুলোতে বিভিন্ন আকৃতি ও স্বাদের বাকরখানি পাওয়া যায়৷ প্রতিটির দাম ২ থেকে ৪ টাকা৷
কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁর চপ, কাটলেট : সুস্বাদু খাবারের জন্য ৪৪ বছরের পুরনো কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁ রসনাবিলাসীদের প্রিয়৷ ১৯৭৮ সালে দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ৷ পুরান ঢাকার কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষকদের আড্ডার জায়গা ছিল এটি৷ এখানে পাওয়া যায় চপ, কাটলেট, মোগলাই পরোটা, চিকেন ফ্রাই ও স্যুপ৷ দাম ১০ থেকে ৫৫ টাকা৷ গেন্ডারিয়ায় কেশব ব্যানার্জি রোডে ৩৪/১ নম্বর দোকানটি খোলা থাকে বিকাল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত৷
নবাবি ডাইন : বৈচিত্র্যময় পদের সুবাদে বেশ নাম করেছে নবাবি ডাইন৷ এখানে টুনা, কোরাল, রূপচাঁদা, তেলাপিয়া ও পোয়া মাছ এবং অক্টোপাস ও স্কুইডের বার-বি-কিউ পাওয়া যায়৷ এছাড়া রয়েছে কাঁকড়া, ব্যাম্বু চিকেন, পাহাড়ি কাবাব ও চিংড়ি কাবাব৷ ওয়ারির টিপু সুলতান রোডে ২৫/১ নম্বর দোকানটি বিকাল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত জমজমাট থাকে৷
আলাউদ্দিনের মিষ্টি : ঐতিহ্যের পরশে জৌলুস ধরে রেখেছে আলাউদ্দিন সুইটমিট৷ ভারতের লক্ষ্মৌ থেকে চকবাজারে এসে মিষ্টি ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন হালওয়াই ১৮৯৪ সালে গড়ে তোলেন আলাউদ্দিন সুইটমিট৷ এটি ঢাকায় প্রথম নামকরা মিষ্টির দোকান৷ এখানকার মিষ্টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য– জাফরানি মিষ্টি, স্পঞ্জ রসগোল্লা, ইত্যাদি৷ ১৫৬ বছরের পুরনো দোকানটিতে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বেচাকেনা চলে৷
সুস্বাদু মাঠা : স্বাদে-গুণে খাঁটি মাঠা শত বছরের ঐতিহ্যবাহী খাবার৷ নবাবপুর রোডে রথখোলার মোড়ে ৪০ বছর ধরে মাঠা বিক্রি করছেন বাবুল দাস৷ ভোর ৫টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত চলে ব্যস্ততা৷ দুধ, টক দই, ছানা ও লবণ দিয়ে মাঠা বানিয়ে পরিবেশন করেন তিনি৷ প্রতি গ্লাস ৫ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা৷ রথখোলার মোড়ে আড়ত থেকে দুধ সংগ্রহ করেন বাবুল দাস৷ পাশেই আদি মরণচাঁদ ঘোষ অ্যান্ড সন্স দোকানটি রয়েছে৷
নিউ ক্যাফে কর্নারের ক্রামচাপ : ছয় দশক ধরে চিরচেনা স্বাদ ধরে রেখেছে ‘নিউ ক্যাফে কর্নার’৷ কবি-সাহিত্যিকরা এখানে আড্ডা দিতেন এক সময়৷ ১৯৬২ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন হরিনারায়ণ ঘোষ। এর বর্তমান স্বত্বাধিকারী হাজী সোলায়মান৷ রেস্তোরাঁটির জনপ্রিয় পদ ক্রামচাপ ব্রিটিশরা পছন্দ করতো৷ ১৫০ টাকায় খাসির মাংসের এই সুস্বাদু খাবারটি পাউরুটির সঙ্গে পরিবেশন করা হয়৷ এছাড়া রয়েছে খাসির ভুনা, মোরগ পোলাও, আলুর চপ, মোগলাই, কাটলেট ও চিকেন ফ্রাই৷
গ্র্যান্ড নবাব : নান্দনিক নবাবি অন্দরসজ্জা ও সুস্বাদু খাবারের মিশেল হল গ্র্যান্ড নবাব৷ এখানকার জনপ্রিয় পদ বার বি কিউ কাচ্চি বিরিয়ানি (২২০ টাকা), খাসির লেগ কাচ্চি (৩০০ টাকা), বার বি কিউ চিকেন রোস্ট (১২০ টাকা), জাফরানি শরবত (২৮০ টাকা)৷ সাত রওজার কাছে আবুল হাসনাত রোডে ১৩/১ নম্বর দোকানটিতে দুপুর ১২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বেচাকেনা হয়৷