জাকির হোসেন, পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি : দেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি। এখন গ্রামগঞ্জে আগের মতো আর চোখে পড়ে না গরুর গাড়ি- যা এক সময় ঠাকুরগাঁওয়ের সকল উপজেলার জনপদে দেখা মিলতো।

সভ্যতার প্রায় উন্মেষকাল থেকেই বাংলাদেশের সব জায়গায় যাতায়াত ও পরিবহনের জন্য একটি গুরত্বপূর্ণ যান ছিল ‘গরুর গাড়ি’। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার বিবর্তনে যন্ত্রচালিত লাঙল বা পাওয়ার টিলার এবং নানা যন্ত্রযানের উদ্ভবের ফলে বিলুপ্তির পথে ‘গরুর গাড়ি’।

এ জেলার ৪টি উপজেলার ৫টি থানার ৫৩টি ইউনিয়নের গ্রামের মেঠোপথে দেখা যেত গরুর গাড়ি। ছিল সর্বত্র এই গরুর গাড়ির মর্যাদাও। দু’টি গরু দিয়ে পিছনের গাড়ি চলতো ‘ঠাই ঠাই’ করে। বিয়েশাদি থেকে শুরু করে অন্য কোন অনুষ্ঠানে মানুষ বহনের জন্য ‘ছই ওয়ালা’ গরুর গাড়ি ছাড়া যেন কল্পনাই করতে পাতেন না এইসব গ্রামের মানুষ।

মানুষ পরিবহনের পর গরুর গাড়ি হরহামেশা ব্যবহৃত হতো মাঠের ফসল আনা-নেয়ার কাজে। সেটাও যেনো এখন বিলুপ্তপ্রায় আধুনিকতা আর যান্ত্রিক বাহনের আধিক্যতায়। এমনকি ফসল কাটার পর ফাঁকা মাঠে গরুর গাড়ির প্রতিযোগিতা হতো-গাড়ি নিয়ে কার গরু আগে যায় দেখার জন্য। সেই বিশেষ প্রতিযোগিতাও এখন তেমনটা আর দেখা যায় না।

বাঁশ দিয়ে পেছনের ফ্রেম তৈরি করে গরুর গাড়ি বানানো হতো। সেই গাড়ির চাকার জন্য কামারের কাছ থেকে লোহার পাত সংযুক্ত করা হতো। শতভাগ জ্বালানীবিহীন ও পরিবেশবান্ধব গরুর গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে কোনো খরচ হতো না। শুধু গাড়ি বহনের দু’টি গরুর পিছনে যা খরচ হতো। আবার সেই গরুও বিক্রি করে আর্থিক লাভবান হওয়া যেতো।

প্রবীণরা জানালেন, জেলাব্যাপী এক সময় গরুর গাড়ি চলত প্রতিনিয়ত। কিন্তু এখন এই সব জনপদে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই গরুর গাড়ি। অবশ্য এখনো মাঝে-মধ্যে গ্রামাঞ্চলগুলোতে দুই-একটি গরুর গাড়ি চোখে পড়ে। কিন্তু সেগুলোর অবস্থাও নাজুক।

পীরগঞ্জ উপজেলার জয়কৃষ্টপুর গ্রামের ৮০উর্দ্ধো বয়সী বেঙ্গু মোহাম্মদ জানান, আজ শহরের ছেলে মেয়েরা তো দূরের কথা,গ্রামের ছেলে মেয়েরাও গরুর গাড়ি যানবাহনটির সাথে খুব একটা পরিচিত নয়। আগে অনেকেরই গরুর গাড়ি ছিল উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন।

সিঙ্গারোল দহপাড়া গ্রামের হাসান আলী ডিলার বলেন,আমার বাবা দাদারা গরুর গাড়ি চালিয়ে উপার্জন করে আমাদের বড় করেছেন। এই আধুনিক যুগে গরুর গাড়ি নেই, আছে অটো বা ইঞ্জিন চালিত যানবাহন। মানুষের গরুর গাড়ির ওপর চাহিদা নেই।

উপজেলার পীরগঞ্জ শহরের কৃষক লীগের সভাপতি ও গরুর গাড়ির মালিক আব্দুল জলিল বলেন, আগে মালামাল বহন করার জন্য গরুর গাড়ির বিকল্প ছিল না। শুধু মালামালই নয়, বিয়ের জন্য বা আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার একমাত্র ভরসা ছিলো গরুর গাড়ি। মাঠের ফসল বহনের জন্য গরুর গাড়ির বিকল্প ছিল না। এমনকি ফসল কাটার পর ফাঁকা মাঠে গরুর গাড়ির প্রতিযোগিতা হতো। গাড়ি নিয়ে কার গরু আগে যায় দেখার জন্য। সেই বিশেষ প্রতিযোগিতাও এখন তেমনটা আর দেখা যায় না।’

বর্তমানে আমরা নিজেদের ব্যবহারের জন্য মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার বা মাইক্রো ক্রয় করি ঠিক তেমনি কয়েক যুগ আগেও গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন লোকজন ও গৃহস্থরা গরুর গাড়ি নিজের ব্যবহারের জন্য তৈরি করে বাড়িতে রাখতেন। আপদ-বিপদে তা তারা বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন সেটা। মাঝেমধ্যে তা আবার ভাড়াও দিতেন।

উপজেলার জাবরহাট এলাকার কৃষক মাহাবুবুর রহমান বুলু জানান, এখন গরু আছে কিন্তু গাড়ি নেই। গরুর গাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি হতে চলেছে। পরিবর্তনের যুগে এসে গ্রাম বাংলার সেই জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।

পীরগঞ্জ সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজমুল হুদা বলেন,যান্ত্রিক বাহনের ফলে আজ গ্রামীন ঐতিহ্য পরিবেশ বান্ধব গরুর গাড়ি আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।