এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) : গৌরবগাঁথা বীর চট্টলার প্রবেশদ্বার প্রকৃতির রূপ মাধুর্য্যময় মুহুরী প্রকল্প সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে এই জনপদকে। একদিকে পাহাড় আর অপরদিকে সমুদ্র নিকটবর্তী অরণ্য সর্পিল নদী, ঝর্ণা, বন্যপ্রাণী, প্রাকৃতির রূপ বৈচিত্র্যময় সম্পদে সমৃদ্ধময় আর কবির কথার মত যেন শৈল করীটিনী নদী-মালিনী, বনানী কুন্ততা। প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে সকল সৌন্দর্য্য ঢেলে দিয়েছে ফেনী ও মুহুরী নদীর মোহনার সৃষ্ট মুহুরী প্রকল্প এলাকা হতে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা হয়ে সীতাকুন্ড পেরিয়ে পতেঙ্গা অবধি। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এতদ অঞ্চল নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন- `A Sleeping beauty emerging from the mist and water’ অর্থাৎ ‘পানিও কুয়াশার মাঝে সৃষ্ট ঘুমন্ত এক সৌন্দর্য্য’।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত মুহুরী প্রকল্প দেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এর অবদান বিশাল, পাশাপাশি মুহুরী সেচ প্রকল্প হতে পারে একটি অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রকল্পের বিভিন্ন অংশ এবং এর পারিপার্শি¦ক প্রাকৃতিক অনাবিল নৈসর্গিক শোভা যেকোন পর্যটককে আকর্ষিত করতে পারে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের তত্বাবধানে গৃহীত যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে এটিকে গড়ে তোলা যায় একটি অনন্য আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র রূপে। যা থেকে কর্পোরেশন প্রতি বছর পর্যটন খাতে আয় করতে পারে প্রচুর দেশী-বিদেশী বৈদেশিক মুদ্রা।
প্রকল্প পরিচিতি : একসময় মুহুরী প্রকল্পের স্থানে ছিল দেড় দ্ইু মাইল প্রশস্থ নদী। এপার ওপার ছিল বিচ্ছিন্ন। ফেনী নদী এবং মুহুরী নদীর দুই তীরকে সেচ সুবিধার আওতায় আনার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার সীমান্ত বরাবর বয়ে যাওয়া ফেনী নদী এবং মুহুরী নদীর মোহনার কিছুটা ভাটিতে নির্মিত মুুহুরী সেচ প্রকল্প। প্রকল্পের সার্বিক তত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলো ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড। মুহুরী প্রকল্পের অধীনে রয়েছে ফেনী সদর, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া, পরশুরাম থানার আংশিক এবং মিরসরাই থানার উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা। প্রকল্পাধীন এলাকার আয়তন ৪০,০৮০.৯২ হেক্টর। এই এলাকায় আবাদযোগ্য জমির মোট পরিমাণ ২৭,৯২৫০৬ হেক্টর, প্রায় ২৩০৭৬.৯৩ হেক্টর ফসলি জমি। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বার্ষিক অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হয় ৮৫,০০০ মেট্টিক টন।
মুুহুরী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে খরচ হয়েছিল ৯৫,৬৮,৬২৪ লক্ষ টাকা। প্রকল্প পরিচালনায় বর্তমানে কর্তৃপক্ষের বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ভর্তূকির পরিমাণ ২১,৩১৮ লক্ষ টাকা। আয় ব্যায়ের বার্ষিক হিসেবে লাভের পরিমাণ দাঁড়ায় শতকরা ৩২.১৩। মুহুরী প্রকল্পে নির্মাণ কাজ ১৯৭৭-৭৮ সালে শুরু হলেও এর প্রাথমিক কাজ শেষ হতে সময় লাগে ৩ বছর এবং সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে ১৯৮৫-৮৬ সাল পার হয়ে যায়। প্রকল্পের প্রধান অংশসমূহ হচ্ছে ইমারত ৭,৬৪৬ বর্গমিটার, ক্লোজার ড্যাম ১ টি ৩,৪১১ কিলোমিটার। রেগুলেটর একটি ৪০ দরজা বিশিষ্ট নিষ্কাশন কাঠামো নতুন একটি এবং পূর্ণ সংস্কার ৬ টি। খাল পূণঃ খনন ২৮৬.৬ কিলোমিটার রেগুলেটর প্রবাহের পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে ২৭১৮.৭৭৬ ঘন মিটার। প্রকল্পাধীন নদীতে সেচের পানির রিজার্ভের সর্বনিন্ম লেভেল ২.৫৯ মিটার এবং সর্বোচ্চ ৩.৮১ মিটার এবং সর্বোচ্চ প্রকল্পের ফলে বাঁধের দক্ষিণে উদ্ধারকৃত পানির পরিমাণ ৪৮৫৮.২৯৯ হেক্টর এর বেশী।
যোগাযোগ এবং ভ্রমণ : দেশের যেকোন স্থান থেকে মুহুরী প্রজেক্টের সড়ক যোগাযোগ তথা যাতায়াত ব্যবস্থা যথেষ্ট সুবিধাজনক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি পশ্চিম দিকে চলে গেছে, সেটিই সহজতর ও একমাত্র রাস্তা জোরারগঞ্জ হতে প্রজেক্ট পর্যন্ত মাত্র আধকিলোমিটার রাস্তাতেই রয়েছে নিয়মিত বাস, জীপ, টেম্পো বা সিএনজিঅটোরিক্সা সার্ভিস। ভাড়া টেক্সি বা ব্যক্তিগত গাড়িতেই ভ্রমণে সুবিধাজনক হয়। একাকী কিংবা দলবদ্ধভাবে মুহুরী প্রজেক্টে ভ্রমণের পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। জোরারগঞ্জ হতে প্রজেক্ট রোডে আট কিলোমিটার চলার পর প্রকল্পের দীর্ঘ ড্যামের (বাঁধের) পূর্ব প্রান্তে পৌঁছা যাবে।
এখান থেকে পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়িতে অথবা রিক্সা করে ড্যামের পশ্চিম প্রান্তে সুদৃশ্যময় স্থান রেগুলেটর পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বাঁধের উত্তরের নীল জলরাশি আর দক্ষিণের দিগন্ত বিস্তৃত চর এবং প্রাকৃতির নৈসর্গিক শোভামন্ডিত পরিবেশ, পাইন গাছের সারি, ঝাউ বন, প্রাকৃতিক কাশফুলে ভরা ঘাস প্রকৃতির নৈসর্গিক শোভামন্ডিত পরিবেশ যেকোন পর্যটককেই আকর্ষণ করতে পারে। দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম প্রধান আকর্ষণ চল্লি¬শ দরজা বিশিষ্ট সারিবদ্ধ রেগুলেটর।
এ ছাড়া বাঁধের মূলগোড়া থেকে প্রকল্পে প্রবেশ না করে বেড়িবাঁধ দিয়ে সোজা দক্ষিণে এলেই রয়েছে উপক‚লীয় বনবিভাগ কর্তৃক সৃজন করা কৃত্রিম সুন্দরবন। এখানে বনের ফাঁকে ফাঁকে সর্পিল আকারে বয়ে গেছে ছোট ছোট নদী, বনে রয়েছে কৃত্রিম উপায়ে ছাড়া হরিণ, বানরসহ অনেক বন্য পশুপাখি। এখানে পর্যটকদের জন্যে উন্নত সহজ কোন হোটেল রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা নেই। ফাঁকে ফাঁকে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি রেস্টুরেন্ট তাই নিজ দায়িত্বেই খাবারের আয়োজনের জন্যে রেগুলেটরের উত্তর পশ্চিমের ছোট বনে রান্না বান্না এবং ভোজের আয়োজন করা যেতে পারে। দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে ২/১ টি অস্থায়ী ভাসমান চা দোকান বসে। এখানে রাত্রীযাপনের কোন সুব্যবস্থা নেই।
পর্যটন : পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে মুহুরী সেচ প্রকল্প একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। পর্যটন কর্পোরেশন এ যাবৎ কোন বৃহত্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। প্রতিদিন শত শত মানুষ দূূর দুরান্ত হতে এসে এখানে আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী দেখে রোমাঞ্চিত হয়। উন্নত এবং আধুনিক ব্যবস্থা রাত্রী যাপন খাবারের আয়োজন থাকলে এই স্থান আরো আকর্ষণীয় হতে পারে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিলেই পুরো প্রকল্প এলাকাকে সবুজ অরণ্যে রুপান্তর করা যায়। বাঁধের উত্তরপার্শ্বে ঝাড় পাইনসহ সুদৃশ্য গাছ লাগানো যেতে পারে, আর দক্ষিণে অন্তত ১ কিলোমিটার এলাকায় সৃষ্টি করা যেতে পারে সবুজের সমারোহ।
বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত প্রাকৃতিক উপাদান এখানে বিপুল পরিমাণেই বিদ্যমান। মহিষ খামার, ভেড়ার খামার, হ্যাচারী, মৎস্য ঘের, চারণভূমি ইত্যাদির পাশাপাশি জলজ প্রাণীসমৃদ্ধ একটি আধুনিক মিউজিয়াম গড়ে তুললে এর আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। উত্তর পার্শ্বের বিশাল লেকে স্পীডবোট ভ্রমণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নৌপথে সহজ যোগাযোগের জন্যে বঙ্গোপসাগর থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে তথা প্রকল্প এলাকায় নৌবন্দর প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। তবে স্থানীয় মাস্তানদের হাত থেকে পর্যটকদের রক্ষার জন্য পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যটন কর্পোরেশন যদি মুহুরী সেচ প্রকল্পকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে এটি হতে পারে একটি অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। যা থেকে কর্পোরেশন বছরে আয় করতে পারে প্রচুর দেশী-বিদেশী মুদ্রা।
থাকা ও খাওয়া : এখানে ঘুরতে আসলে আশপাশে ভালো থাকার ও খাবার হোটেল না থাকলেও পর্যটন স্পট থেকে ১ ঘন্টার পথ চট্টগ্রাম শহরের মুখে একেখাঁনে কুটুম্ববাড়ি রেস্তোরা থাকার জন্য মায়ামী রিসোর্ট এবং অলংকারে রোজভিও আবাসিক হোটেল রয়েছে।