এম এম হারুন আল রশীদ হীরা, নওগাঁ : পরচুলা বা চুল দিয়ে ক্যাপ তৈরির মাধ্যমে নওগাঁর মান্দা ও মহাদেবপুরে নারীদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। জেলার ও-ই দুই উপজেলার কয়েকটি গ্রামে গড়ে উঠেছে পরচুলা বা ‘হেয়ার ক্যাপ’ তৈরির কারখানা।
এসব কারখানায় কাজ করছেন এলাকার দরিদ্র নারী, স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। টাক মাথার জন্য ব্যবহার করা এসব ক্যাপ তৈরি করে প্রতি মাসে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা আয় করছেন তারা। শিক্ষার্থীরা নিজের লেখাপড়াসহ সংসারের খরচে ভূমিকা রাখছেন।
আর এ পরচুলকে কেন্দ্র মান্দা উপজেলার সাটইল, সাতবাড়িয়া, চৌবাড়িয়া ও হোসেনপুর, মসিদপুরসহ কয়েকটি গ্রামে হেয়ার ক্যাপ তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়াও মহাদেবপুরের এনায়েতপুর, চকহরিবল্লভ আদর্শগ্রাম, শীবপুর, চকগোবিন্দপুর, গণনপুরন গ্রামে অনেক আগেই এসব কাজ করছেন স্থানীয়রা।
যেখানে প্রায় পাঁচ হাজার দরিদ্র নারী, স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান হয়েছে। তারা এ কাজ করে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বীও হচ্ছেন। প্রতি মাসে হেয়ার ক্যাপ তৈরী করে ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা আয় করছেন তারা। শিক্ষার্থীরা নিজেদের কাজে টাকা ব্যবহারের পাশাপাশি সংসারে দিয়েও সহযোগীতা করছে। পরচুলা দিয়ে হেয়ার ক্যাপ তৈরীর আগে দুইদিন সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, এখানে এমন একটি কারখানা হওয়ায় গ্রামের অনেক গরিব পরিবারের মেয়েরা কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এমনকি যারা লেখাপড়া করেন তারাও এখানে কাজ করে তাদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন।
মান্দা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের সাটইল গ্রামের মধ্যপাড়ায় গত পাঁচমাস আগে হেয়ার ক্যাপ তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানে দ্বাদশ শ্রেনীর ছাত্রী সুবিতা আক্তার রত্না গত পাঁচমাস থেকে পরচুলা থেকে ক্যাপ তৈরীর কাজ করছেন। এ কাজ করে মাসে প্রায় ৩৫০০ টাকা আয় করেন।
তিনি বলেন, করোনার মধ্যে দীর্ঘদিন কলেজ বন্ধ ছিল। তখন সময় বেশি পেতাম এবং কাজও বেশি হতো। একটি ক্যাপ তৈরী করতে তিনদিনের মতো সময় লাগতো। এখন কলেজ চালু হওয়ায় কাজ কম করতে পারছি। তারপরও গত অক্টোবর মাসে ২৫০০ টাকা আয় করেছি। বাবার কাছে টাকার জন্য হাত পাততে হয়না। এ কাজ করে নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসারে টাকা দিয়ে সহযোগীতা করা হয়।
এ গ্রামের কারখানার দলের অধিনায়ক রোশিদা বেগম বলেন, আমার অধীনে ২০ জন ক্যাপ তৈরীর কাজ করে। এরমধ্যে ছয়জনই ছাত্রী। তারা পড়াশুনার পাশাপাশি এ কাজ করে। আর গৃহবধুরা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এ কাজ করে বাড়তি আয় করে। সকাল থেকে চলে দুপুর পর্যন্ত। মাঝখানে একটা বিরতি। এরপর আড়াইটা থেকে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। নিজের কাজের পাশাপাশি সবার কাজ দেখভাল করি। কারো কোন সমস্যা হলে শিখিয়ে দিয়। এ কাজ করে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার মতো আয় করে থাকি। এছাড়া দলের অধিনায়ক হিসেবে তদারকি করায় বাড়তি আরো কিছু টাকা দেয় মহাজন। যে টাকা উপার্জন করি, এতে সংসার এখন ভালোভাবেই চলে।
মহাদেবপুর উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের চকহরিবল্লভ আদর্শ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এ গ্রামের অফিস ঘরে পরচুলা বা চুল দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতের কাজ করছেন তারা। এ কারখানায় বিভিন্ন বয়সী আশা আকতার, সোনালী আক্তার, তনু খাতুন, শাহানারা খাতুন, মিনা আকতার, শিখা রাণীসহ ৩০ জন নারী গত দুইমাস থেকে কাজ করছেন। তারা সবাই দরিদ্র ও স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী। প্রতিটি টেবিলে স্ক্রুর সাহায্যে আটকানো আছে প্লাস্টিকের ড্যামি মাথা। আর ড্যামি মাথা ওপর একটি নেট বা জাল।
আর এ জালের ফাঁকে ফাঁকে সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে খুব মনোযোগ দিয়ে একটি একটি করে চুল আটকানো হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে একই দৃষ্টিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ড্যামি পুরো মাথায় সু² ভাবে চুল আটকানো সম্ভব হলেই ক্যাপ তৈরীর কাজ শেষ। মনোযোগ আর দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক ভাবনা থেকে এক সময় তৈরি হচ্ছে মনোরম টুপি। তাদের হাতের কারিশমায় তৈরি হচ্ছে এ পরচুলা ক্যাপ। আর মাথার ওপর ঝুলছে এনার্জি লাইট। প্রতিটি টেবিলে দুইজন করে দুইপাশে চারজন কারিগর কাজ করছেন মনযোগ দিয়ে। মনযোগ দিয়ে কাজ না করলে ভুল হওয়ার সম্ভবনা।
জানা গেছে, ৪ বাই ৪ সাইজের প্রতিটি ক্যাপের মজুরি ৪০০ টাকা, ৫ বাই ৫ সাইজের মজুরি ৬০০ টাকা এবং ৪ বাই ১৩ সাইজের ক্যাপের মজুরি ১৩০০ টাকা। প্রকারভেদে প্রতিটি ক্যাপে ২০ গ্রাম থেকে ৫০ গ্রাম পর্যন্ত চুল লাগে। ক্যাপ তৈরীতে লাগে মাথার ড্যামি, চুল, নেট, সুঁচ, সুতা, চক ও পিন। এসব ক্যাপের উপকরণ স্থানীয় মহাজনরা ঢাকা থেকে নিয়ে এসে গ্রামের নারীদের দিয়ে ‘হেয়ার ক্যাপ’ তৈরী করে আবার ঢাকায় পাঠায়। সেখান থেকে রপ্তানি হয় চীন, জাপান, ভারত, দুবাই, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
উপজেলার চকহরিবল্লভ আদর্শ গ্রামে হেয়ার ক্যাপ কারখানায় কাজ করে ষষ্ঠ শ্রেনীর শিক্ষার্থী সোনালী আক্তার। গত একমাস এ কারখানায় কাজ করে ১৩০০ টাকা আয় করেছে। সোনালী জানায়, তার বাবা দিনমজুর। ট্রাক্টরের বালু বহনের কাজসহ বিভিন্ন কাজ করে। মা সংসার দেখাশুনা করে। বাবা-মার অনুমতি নিয়ে এ কারখানায় কাজ করছে। ক্লাস শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এবং স্কুল ছুটি হলে এ কারখানায় এসে কাজ করে। এ কাজ করে যে টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসারে সহযোগীতা করা হয়।
গৃহবধূ সানজিদা আকতার বলেন, স্বামী দিনমজুর। অভাবী সংসারে দুই ছেলে-মেয়ে। বড় ছেলে সপ্তম শ্রেনীতে এবং মেয়ে তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে। স্বামীর অনুমতি নিয়ে সংসার সামলিয়ে গত দুই মাস থেকে কাজটি করছি। কাজ করার আগে দুইদিন প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। ৫ বাই ৫ সাইজের ক্যাপটি করতে তিনদিন সময় লাগে। মজুরি পাওয়া যায় ৬০০ টাকা। গত দুই মাসে সংসার সামলিয়ে আট হাজার টাকা পেয়েছি। তবে যে পরিমাণ ক্যাপের চাহিদা মহাজন দিতে পারে না। এরমধ্যে কিছুদিন কাজ বন্ধও ছিল। পরচুলা ক্যাপ আসার পর আমাদের মতো হতদরিদ্র পরিবারের সুবিধা হয়েছে।
মহাদেবপুর উপজেলা সদরের বাসিন্দা তরুন উদ্যোক্তা আজাহার ইসলাম সুজন (২৭)। তিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ছোট ব্যবসা করতেন। এক বন্ধুর পরামর্শে মান্দার হেয়ার ক্যাপ এর মহাজন জামিল হোসেন এর সঙ্গে পরিচয় হয়। কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলে এরপর তাকে কাজ দেয়া শুরু করেন। গত চারমাস থেকে এ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
আজাহার ইসলাম সুজন বলেন, আমার ছয়টি হেয়ার ক্যাপ তৈরীর কারখানা আছে। যেখানে প্রায় দেড় শতাধিক দরিদ্র নারী ও শিক্ষার্থী কাজ করে। কাজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সে তুলনায় কারিগরদের কাজ দেওয়া সম্ভব হয়না। হতদরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এসব কারখানা থেকে মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা আয় হয়। আর এসব ক্যাপ মহাজনরা ঢাকায় পাঠায়। পরে তারা চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকেন।