কুমিল্লা সংবাদদাতা : দোলনা। শিশুদের দোলনায় দুলিয়ে ঘুম পাড়ানো মায়েদের একটা চিরাচরিত কাজ। দোলনা শিশুদেরও ভীষণ প্রিয়। বড়রাও অনেক সময় গাছের ছায়ায় গাছের ডালে দোলনা বানিয়ে দোল খেয়ে আরাম করেন। অবশ্য বড়দের আরামের দোলনা আর ছোট শিশুদের দোলনা এক না।

শিশুদের দোলনা সুতা, বাঁশ ও রং দিয়ে নিপুণ হাতে বানানো হয়। বাহারি রঙে ও সুতোর কারুকাজে ভরপুর থাকে এ দোলনা।

কুমিল্লার আমিনুল বিশ বছর ধরে দোলনা বানানো ও বিক্রির পেশায় ডুবে আছেন তিনি। দোলনা বিক্রি এখন তার নেশায় পরিণত হয়েছে। এটি তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। আমিনুল (৫০) দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে দোলনা বিক্রি করেন। তিনি তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৈয়ারা গ্রামে নারীদের দিয়ে দোলনা বানান। মাঝে মাঝে তিনি নিজেও দোলনা তৈরি করে থাকেন। দোলনা বানানো শেষ হলেই বিক্রির জন্য ছুটে যান রাজধানী ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায়। দোলনায় থাকে সুতোর নানা কারুকাজ। সুতোকে রং দিয়ে করা হয় আকর্ষণীয়। মেয়েদের চুলের বেণীর মতো করে দোলনা তৈরির সুতোগুলোকেও বেনি করা হয়। এরপর বাঁশের চটির সঙ্গে সুতো বেঁধে তৈরি করা হয় দোলনা।

দোলনার গ্রাম কুমিল্লার দৈয়ারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আধাপাকা বাড়ির একটি মেহগনী গাছের ছায়ায় বসে দোলনা বানাচ্ছিল শিরিনা। তার পাশে ও সুতার তৈরি আরও কিছু দোলনা। কুমিল্লার মুরাদনগরের পল্লীতে বাঁশের কাইম ও সুতায় তৈরি হচ্ছে এ রফতানীযোগ্য পণ্য।

সারাদেশেই দোলনা নামে পরিচিত এ পণ্য উৎপাদন করে ছাত্রছাত্রী ও গৃহবধূরা বাড়তি আয় করছেন, অনেকেই বদলে ফেলেছেন সংসারের চেহারা।

দৈয়ারা গ্রামের শিরিনা জানায়, তারা দিনে গড়ে ৮টি দোলনা বানাতে পারে। এককটি দোলনার দাম ১৮০ থেকে ২শ টাকা পর্যন্ত। তার মতো অনেকেই অবসরে দোলনার কাজ করে।

গৃহবধূ পারভীন, মমতাজ, হোসনেয়ারা, রাশেদারাও বসে নেই। কাজের অবসরে দোলনা তৈরি করে এরা বাড়তি আয় করেন। মমতাজ একটা পাকা বাড়ি করছেন। তার চার মেয়ে হাজেরা, ফারজানা, ছালমা ও রীমা স্কুলে লেখাপড়া করে। তারাও যার যার সময় অনুযায়ী দোলনা তৈরি করে। তারা সকলেই এখন স্বচ্ছল ও স্বাবলম্বী। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেকেই এ পেশার সফল ভোগ করছেন। দৈয়ারা গ্রামের ব্যবসায়ীরা বাঁশের আঁটি বেধে ও ঢাকার মোগরাপাড়ার রহমতগঞ্জ থেকে পিকআপ ভ্যান করে নিয়ে আসেন দৈয়ারা গ্রামে। বাঁশ ও সুতার তৈরি রফতানীযোগ্য পণ্য গ্রামের বেকার অসহায় পুরুষ ও মহিলারা মনে আশার সঞ্চার করেছে।

দৈয়ারা গ্রামটিকে কেন্দ্র করে আশপাশের কয়েকটি পাড়ায় এ কুটির শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে। কুটির শিল্প হলো কাইম ও সুতার তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের দোলনা। মুরাদনগরের দৈয়ারা, বাবুটিপাড়া, মধ্যপাড়া, তেলুয়ামাইনকা এ শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে। তবে দৈয়ারা এর কেন্দ্র। কারণ এ গ্রামকে কেন্দ্র করেই শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে।

জানা যায়, কবির হোসেন নামের এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম কাজ শিখে গ্রামের দরিদ্য মানুষকে শেখান বাঁশের কাইম ও সুতার ধারা দোলনা তৈরির কাজ। অল্প সময়ের মধ্যে কয়েক’শ মানুষ এ কুটির শিল্পের দক্ষ শ্রমিকে পরিণত হয়।

দৈয়ারা গ্রামের দোলনা ব্যবসায়ী রমিজ উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, কবির যখন তার নিজ গ্রামে দোলনা তৈরির কাজ ১৯৯৯ সালে শুরু করলো তখন গাঁয়ের মানুষ দোলনা তৈরির কাজের চাহিদা দেখে আস্তে আস্তে এ কাজের প্রতি আগ্রহী হলো। তখন গাঁয়ের মানুষ কবির হোসেনের কাছে কাজ শিখতে শুরু করে এবং কাজ শিখে এখন পুরো গ্রামে ৩শ’ পরিবারের বেশি এ শিল্পের সাথে জড়িত হওয়ায় কারণে দিন দিন এ শিল্পের প্রসার ঘটছে এ গ্রামে।

পঁচিশ বছর বয়সী রাশেদা বেগম দোলনা তৈরি করেন। তিনি জানান, দোলনা তৈরির সুতা কেনা হয় রহমতগঞ্জ থেকে। প্রথমে সাদা সুতা কেনা হয়, তারপর সেই সুতা প্রয়োজন মতো রঙ করে নেয়া হয়। সুতার রঙও কেনা হয় সোনারগাঁও থেকে। দোলনা তৈরি করা হয় কয়েকটি মাপে। এগুলো প্রতিটি খুচরা বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তবে পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় প্রতিটি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। ঢাকা, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে কিনে নেন এসব দোলনা। অনেক পাইকার দোলনা তৈরির অর্ডারও দেন। অনেক সময় যারা দোলনা তৈরি করেন, তারা নিজেরাই বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পাইকারী বাজারে বিক্রি করে আসেন।

এখানকার দোলনা তৈরির কারিগর হোসনেয়ারা বেগম জানান, পুরো দোলনাটি তৈরি হয় কয়েকটি ধাপে এবং কয়েকজন কারিগরের মাধ্যমে। যেমন, একজন কেবল বাঁশের চাক বা চাঁকা তৈরি করেন। প্রতিটি বাঁশের চাকা তৈরির মজুরি ৩ থেকে ৪ টাকা। আবার একজন শুধু সেই বাঁশের চাকায় সুতা প্যাঁচান। প্রতিটি বাঁশের চাকায় সুতা পেঁচানোর মজুরি ৫ থেকে ৬ টাকা। আবার একজন কেবল দোলনা ঝুলিয়ে রাখার দড়ি বা চেইন (স্থানীয়দের ভাষায় চেইন বলে) তৈরি করেন। চেইন তৈরির মজুরি প্রতিটির জন্য ২ থেকে ৩ টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন যিনি পুরো দোলনাটি বুনেন।

দোলনা তৈরির কারিগর পারভিন বেগম জানান, সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে দোলনা তৈরি করেন। এ দোলনা তৈরি করেই চলে তাদের সংসার। ছেলে-মেয়েরাও লেখাপড়া করছে। দোলনা তৈরির সব কাজ তিনি নিজেই করেন। স্বামী-সন্তানরাও তার কাজে সহযোগিতা করেন।

অর্চনা রানী সরকার জানান, দোলনা তৈরি এখানকার কয়েক শত নারী-পুরুষের ভাগ্য বদল করে দিয়েছে। শুধু দোলনা তৈরি করেই তারা আজ স্বচ্ছল জীবন-যাপন করছেন।

দোলনার বাঁশের চাকায় সুতা পেঁচানোর কাজ করেন ফাতেমা আকতার। তিনি জানান, তাদের মতো অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে দোলনার কাজ করে সংসারে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি করেছে।

দোলনার চেইন তৈরির কারিগর শিরিন আকতার জানান, তাদের গ্রামে দোলনা তৈরির প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে অনেক শিক্ষার্থী নিজেরাই নিজেদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে পারছেন।

দোলনা ব্যবসায়ী নজির আহমেদ জানান, তাদের এ কুটির শিল্পের মাল কুমিল্লাসহ ঢাকা, চট্রগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা, নেত্রকোনা, বরিশাল, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, রাঙ্গমাটি, খুলনা ও কক্সবাজার যায়। তবে এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজেরা বাড়ীতে এসব পণ্য তৈরী করে বিক্রি করেন শহরে শহরে ফেরি করে।

এরকম একজন হলেন- দৈয়ারা গ্রামের শহীদ। শহীদ জানান, তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন বাড়ী থেকে পণ্য এনে বিক্রি করেন শহরে। এ ছাড়াও মাপে ছোট বড় কিংবা অন্য কোন কারণে পণ্য সামান্য নষ্ট হলে তারা পণ্য বিক্রি করে দেয় তার কাছে। এভাবে শহরে ফেরি করে পণ্য বিক্রি করে তার দিনে ৫-৬শ’ টাকা লাভ হয়। এ কুটির শিল্পে ব্যবহৃত হয় পাহাড়ী বাস ও সুতা। তবে এই পাহাড়ী বাঁশ কুমিল্লার মাধাইয়া বাজার থেকে প্রতি পিস দেড় থেকে ২০০ টাকায় এবং ঢাকার মোগরাপাড়া এলাকার রহমতগঞ্জ থেকে সাদা সুতা (প্রতি কেজি ৮০ টাকা) এনে এগুলো বিভিন্ন রং দ্বারা ডিজাইন করা হয়।

শ্রমিকরা জানিয়েছেন, প্রতিটি দোলনা তৈরিতে বাঁশের পরিমাণ কম লাগলেও সুতার প্রয়োজন হয় বেশি। প্রতি ১ কেজি সুতায় ছোট আকারের ১টি দোলনা তৈরি করা যায় বলে জানিয়েছেন তারা।