এবারও বিশ্ব ইজতেমার যুগপৎ আয়োজন ব্যর্থ

শেখ আজিজুল হক, গাজীপুর মহানগর : করোনা পরিস্থিতির কারণে দুই বছর পর আজ শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে তাবলিগ জামাতের বহু আখাক্সিক্ষত এবারের বিশ্ব ইজতেমা। তবে ভেতর-বাইরের বহু প্রচেষ্টার পরও তাবলিগ জামাতে বিভক্তির অবসান না হওয়ায় এবারও যুগপৎ ইজতেমা অনুষ্ঠানের আয়োজন ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তৃতীয় বারের মতো এবারো অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুই গ্রুপের আলাদা ইজতেমা। এবারো প্রথম ধাপে ইজতেমা আয়োজনের সুযোগ পেয়েছেন জোবায়ের পন্থী আ’লমী শূরা (বিশ্ব পরামর্শসভা)।

আগামী ১৫ জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে তাদের ইজতেমা।

আগামী ২০ জানুয়ারী শুরু হবে মাওলানা সা’দ কান্দলভি পন্থীদের ইজতেমা। আগামী ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে তাদের ইজতেমা। তবে তাবলিগ জামাতের সাধারণ অনুসারীরা অনাকাক্সিক্ষত এ বিভক্তি চান না, তারা মনে করেন বাহিরের তৃতীয় কোনো অদৃশ্য শক্তি এ বিরোধ জিইয়ে রেখেছে। তারা অবিলম্বে এই বিভক্তির অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব ইজতেমা তথা তাবলিগ জামাতের ঐহিত্য ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।

সর্বশেষ ২০২০ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠানের পর করোনা পরিস্থিতি ও তাবলিগের দ্বিধাবিভক্তির কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। বিগত ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত ইজতেমায় মুরব্বীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২১ সালের ৮, ৯ ও ১০ জানুয়ারি প্রথম পর্ব এবং ১৫, ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্বে ইজতেমা হওয়ার কথা ছিল। ওই ইজতেমার প্রাক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জোড় ইজতেমাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি বিধি নিষেধের কারণে ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা সমাপ্ত হওয়ার পর তাবলিগ সাথীরা ২০২১ সালের ইজতেমা অনুষ্ঠানের অনিশ্চিয়তা নিয়ে ময়দান ত্যাগ করেন।

যদিও তাবলিগ জামাত দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার পর ২০১৯ সাল থেকেই তাদের জোড় ইজতিমা ও বিশ্ব ইজতেমাসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়োজনে ছন্দপতন ঘটছে। তবে এসব অনাকাক্সিক্ষত পরিস্তিতিতেও তাবলিগ জামাতের প্রতি ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগ-আগ্রহের বিন্দু পরিমাণ কমতি হয়নি। তাবলিগের দ্বীন প্রচার কাজেও তেমন কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি। এবারের বিশ্ব ইজতেমা যার প্রমাণ।

শুক্রবার থেকে বিশ্ব ইজতেমা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও গত বুধবার থেকেই মুসল্লিরা ময়দানে এসে অবস্থান করছেন। গতকাল বৃহস্পতিবারই পুরো ময়দান কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার বাদ ফজর থেকেই সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বয়ানও শুরু করেছেন তাবলিগ মুরব্বীগণ।

ময়দানে প্রথম পর্বে খিত্তাভিত্তিক মুসল্লিদের অবস্থান : এবছর প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা যেসমস্ত খিত্তায় অবস্থান করবেন তা হলো-গাজীপুর (খিত্তা-১), টঙ্গী (খিত্তা-২,৩ ও ৪), ঢাকা (খিত্তা-৫ থেকে ১৮ ও ২১, ২২, ২৫, ২৭, ২৮, ৩০), রাজশাহী (খিত্তা-১৯), চাপাই নবাবগঞ্জ (খিত্তা-২০), নাটোর (খিত্তা-২৩), নওগাঁ (খিত্তা-২৪), নড়াইল (খিত্তা-২৬), সিরাজগঞ্জ (খিত্তা-২৯), টাঙ্গাইল (খিত্তা-৩১), রংপুর (খিত্তা-৩২), গাইবান্ধা (খিত্তা-৩৩), লালমনিরহাট (খিত্তা-৩৪), মুন্সিগঞ্জ (খিত্তা-৩৫), যশোর (খিত্তা-৩৬), নীলফামারী (খিত্তা-৩৭), বগুড়া (খিত্তা-৩৮), জয়পুরহাট (খিত্তা-৩৯), নারায়নগঞ্জ (খিত্তা-৪০), ফরিদপুর (খিত্তা-৪১), ভোলা (খিত্তা-৪২), নরসিংদি (খিত্তা-৪৩), সাতক্ষীরা (খিত্তা-৪৪), বাগেরহাট (খিত্তা-৪৫), কুষ্টিয়া (খিত্তা-৪৬), মেহেরপুর (খিত্তা-৪৭), চুয়াডাঙ্গা (খিত্তা-৪৮), ময়মনসিংহ (খিত্তা-৪৯, ৫১), শেরপুর (খিত্তা-৫০), জামালপুর (খিত্তা-৫২), গোপালগঞ্জ (খিত্তা-৫৩), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা-৫৪), নেত্রকোনা (খিত্তা-৫৫), ঝালকাঠি (খিত্তা-৫৬), বান্দরবন (খিত্তা-৫৭), বরিশাল (খিত্তা-৫৮), পিরোজপুর (খিত্তা-৫৯), হবিগঞ্জ (খিত্তা-৬০), কক্সবাজার (খিত্তা-৬১), সিলেট (খিত্তা-৬২), সুনামগঞ্জ (খিত্তা-৬৩), ফেনী (খিত্তা-৬৪), নোয়াখালী (খিত্তা-৬৫), ল²ীপুর (খিত্তা-৬৬), চাঁদপুর (খিত্তা-৬৭), বি.বাড়ীয়া (খিত্তা-৬৮), খুলনা (খিত্তা-৬৯), পটুয়াখালী (খিত্তা-৭০), বরগুনা (খিত্তা-৭১), চট্টগ্রাম (খিত্তা-৭৪), কুমিল্লা (খিত্তা-৭৫), তুরাগ নদের পশ্চিমপাড় কাঁচাবাজারে মৌলভীবাজার (খিত্তা-৭৬), রাজবাড়ী (খিত্তা-৭৭), মাদারীপুর (খিত্তা-৭৮), শরীয়তপুর (খিত্তা-৭৯), মানিকগঞ্জ (খিত্তা-৮০, সাফা টাওয়ার), রাঙ্গামাটি (খিত্তা-৮১), খাগড়াছড়ি (খিত্তা-৮২), দিনাজপুর (খিত্তা-৮৩), পাবনা (খিত্তা-৮৪), ঠাকুরগাঁও (খিত্তা-৮৫), ঝিনাইদাহ (খিত্তা-৮৭, যমুনা প্লট), মাগুরা (খিত্তা-৮৮, যমুনা প্লট), কুড়িগ্রাম (খিত্তা-৮৯, কামারপাড়া বেড়ীবাঁধ বঙ্গবন্ধু মাঠ), পঞ্চগড়ের (খিত্তা-৯০, কামারপাড়া হাইস্কুল মাঠ-বধির স্কুল ভবন) জন্য নির্ধারিতস্থানে অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকবেন। এছাড়াও ময়দানের চারপাশে ১১ ও ১২নং খিত্তার কিয়দংশ, ৩২ ও ৩৭নং খিত্তার মাঝামাঝি ১২নং, ৭২, ৭৩, ৮৬ ও ৯১নং খিত্তাগুলো সংরক্ষিত হিসেবে রাখা হয়েছে বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি ডাঃ কাজী শাহাবুদ্দিন।

ইজতেমায় ঘণ্টায় ১৮ লাখ লিটার পানি সরবারহ করবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ : গাজীপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ভিবাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আলমগীর মিয়া জানান, মুসল্লিদের সার্বক্ষনিক পানি সরবরাহের জন্য তারা ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। এবছর ইজতেমায় ১১শ’ ফিট গভীরতা বিশিষ্ট দুটি নতুন গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এনিয়ে ইজতেমা ময়দানে সর্বমোট ১৬টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ১৮ লাখ লিটার পানি সরবরাহ করা হবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন, বিএসপি (বার),এনডিসি, পিএসসি, জি,এমফিল জানান, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। পুরো ময়দান ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারলেস ফ্রিকোয়েন্সির আওতায় আনা হয়েছে। অগ্নিদূর্ঘটনা মোকাবেলায় ময়দানের প্রতিটি খিত্তায় ফায়ার এক্সটিংগুইসার, ফায়ার হুক, ফায়ার বিটারসহ দুইজন করে ফায়ার ফাইটার দায়িত্ব পালন করবেন। তুরাগ নদীসহ ময়দানের চারপাশে ১৪টি পোর্টেবল পাম্প প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এ ছাড়াও ময়দানের বিভিন্ন স্থানে ৪টি পানিবাহী গাড়ি, রোগী পরিবহনে ৫টি এ্যাম্বুলেন্স, সহজে বহনযোগ্য স্পীড বোট, পিকআপে ডুবুরিদল, বেশ কয়েকটি টু হইলার, ১৩টি জেনারেটর এবং লাইটিং ইউনিট মোতায়েন থাকবে। পুরো ময়দানে ফায়ার সার্ভিসের ৩৬১ জন কর্মকর্তা ও ফায়ার ফাইটার মোতায়েন থাকবেন। ময়দানে ফায়ার কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও টঙ্গী, উত্তরা ও জয়দেবপুর ফায়ার স্টেশনগুলো স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে।

মুসল্লিদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম : ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে প্রথম পর্বে ব্যাপক প্রস্তুতি হাতে নেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম। আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্য সেবায় ময়দানের হোন্ডা কারখানা গেট, বাটা সু গেট, মুন্নু গেট, বিদেশি তাবু ও রেলওয়ে জংশনে স্থাপিত ৫টি মেডিকেল ক্যাম্প থেকে ২৪ ঘন্টা মুসল্লিদের বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য হাসপাতালে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, বক্ষব্যাধি/ এ্যাজমা ইউনিট, হৃদরোগ ইউনিট, ট্রমা (অর্থোপেডিক) ইউনিট, বার্ণ ইউনিট, ডায়রিয়া ইউনিট, স্যানিটেশন টিম এবং ১৪টি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়াও ইজতেমা উপলক্ষে ৭টি বিশেষজ্ঞ দল কাজ করবে।