বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সুনির্দিষ্ট মাপ ও রং রয়েছে। ছবি: ইন্টারনেট
খোলাবার্তা২৪ ডেস্ক : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককের বিজয় দিবসে শ্রদ্ধা জানানোর সময় ভিন্ন রকমের (লাল রঙের বৃত্তের পরিবর্তে চার কোণা একটি আকৃতি) একটি পতাকা ব্যবহার করার বিরুদ্ধে থানায় এজাহার দাখিল করেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই দু’জন অধ্যাপক।
বিশ্ববিদ্যালয়টির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুল হক এবং গণিত বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মো. মশিউর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজনকে অপরাধী করে দাখিল করা তাদের এজাহারে সংবিধান লঙ্ঘন করে জাতীয় পতাকা বিকৃত, তা উপস্থাপন ও অবমাননার অভিযোগ এনেছেন।
বিজয় দিবসে শ্রদ্ধা জানানোর সময় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন শিক্ষকদের তোলা ওই ছবিটিতে যে পতাকাটি ব্যবহার করতে দেখা যায় সেটিতে সবুজ জমিনে লাল রঙের বৃত্তের পরিবর্তে চার কোণা একটি আকৃতি বসানো হয়েছে।
ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং ব্যবহার করা পতাকার নকশায় পরিবর্তন আনার সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক জুড়ে। সামাজিক মাধ্যমে এর প্রতিবাদ এবং নিন্দারও ঝড় ওঠে।
এমন পতাকা ব্যবহারের সমালোচনা করে ফেসবুকে এর আগে একটি পোস্ট দেন থানায় অভিযোগাকারীদের একজন – গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুল হক।
তিনি তার পোস্টে লেখেন, “আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে লজ্জিত। কারণ এরা সবাই শিক্ষক।”
“বিজয় দিবসে জাতীয় পতাকাকে অবমাননা! পতাকার ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে। বৃত্ত না দিয়ে চারকোণার মতো আকৃতি দেয়া হয়েছে। নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
মাহমুদুল হক বিবিসিকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের এটা একটা সেন্ট্রাল প্রোগ্রাম। এর পুরো দায়-দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং কর্তৃপক্ষের। যারা করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের যারা এর সাথে রয়েছে তারা সবাই সমভাবে অপরাধী।”
বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকের বেশ কয়েকটি গ্রুপও পোস্ট দিয়েছে এবং এর সমালোচনা করেছে।
এই ছবিটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আওয়ার ক্যাম্পাস নামে একটি গ্রুপ থেকে ছবিটি পোস্ট করে বলা হয়েছে, “বিজয় দিবসে জাতীয় পতাকার নতুন মডেল উন্মোচন বেরোবি (বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষকদের, আহা! আহা!”
তৌফিক-উর-রহমান নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী অন্য আরেকটি গ্রুপের পোস্ট শেয়ার করে লেখেন, “বাহ!! জাতীয় পতাকার নতুন ডিজাইন!!”
শিক্ষকরা কী বলছেন?
জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে যে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে সেখানে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক মাসুদুল হাসান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরিয়াল বডিরও একজন সদস্য। তাকেও এজাহারে অপরাধীদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
মি. হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, একদিকে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক, প্রোক্টরিয়াল বডির সদস্য এবং শারীরিক শিক্ষা বিভাগের পরিচালক হিসেবে বিজয় দিবসে বেশ কয়েক দফায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে হয়েছে তাকে।
ফুল দিতে গিয়ে অনেকের সাথেই তাকে ছবি তুলতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “হঠাৎ করে আমি আমার পেছনের দিকে খেয়াল করলাম যে কয়েক জন শিক্ষক পতাকা সদৃশ কিছু একটা নিয়ে ছবি তুলছে। তো আমি পেছন দিক থেকেই তাদের সাথে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।”
তিনি বলেন, কেউ যখন পতাকা নিয়ে ছবি তুলবে তখন সেটার মাপ-জোক যে ঠিক থাকবে না, সেটি তার মাথাতেই আসেনি। তিনি পতাকাটি সামনে থেকে দেখেননি বলেও জানান।
“রাত্রে ছবিটা দেখে নিজের থেকেই খারাপ লেগেছে,” তিনি বলেন।
তবে পতাকাটি কে বা কারা এনেছে সে বিষয়টি এখনো জানা সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।
ছবিটিতে ছিলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক তাবিউর রহমান প্রধান। তিনি বলেন, অনেক শিক্ষকই ছবি তুলেছেন।
তবে যে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে সেটিতে যে পতাকা দেখা যাচ্ছে সেটি আসলে পতাকা নয়, বরং ব্যানারের মতো ছিল।
“সবাই দাঁড়িয়েছে লাল-সবুজ পতাকা দেখে, এটি একটি ব্যানার হিসেবে। ছবি তোলার সময় তো আর এটা দেখা হয় নাই যে এটা ঠিক আছে কিনা।”
তিনি বলেন, “এটা কোন আনুষ্ঠানিক পতাকা না। আর এটা কোথা থেকে আসছে তা আমরা কিছুই জানতাম না।”
তিনি জানান যে, এটা উদ্দেশ্যমূলক ছিল না। এটা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন এবং অনুতপ্ত।
এরই মধ্যে তারা এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
“এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। এটা ভাইরাল করার কারণে মানুষ ভুল বুঝছে।”
এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
জাতীয় পতাকা নিয়ে আইনে কী বলা আছে?
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, বাংলাদেশে অবমাননার বিষয়ে সাধারণত মানহানি বা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করাকে বোঝানো হয়।
তবে বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় প্রতীক নিয়ে ১৯৭২ সালের একটি আইন রয়েছে।
যেখানে বলা হয়েছে যে, আমার সোনার বাংলা জাতীয় সংগীত, লাল-সবুজ রঙের জাতীয় পতাকা এবং শাপলা হচ্ছে জাতীয় প্রতীক। এগুলোকে তিনটি আলাদা ধারা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
“বলা হয়েছে যে ‘৭২ সালের আইনটির ধারা অমান্য করলে বা ভঙ্গ করলে এক বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।”
আইনের ধারা ভঙ্গ করা বলতে বোঝায় যে, সোনার বাংলা ছাড়া যদি অন্য কিছুকে জাতীয় সংগীত বলা হয়, কিংবা পতাকার ক্ষেত্রে যদি লাল-সবুজের পরিবর্তে অন্য কোন রং বা এর আকারে ৫:৩ এর পরিমাপের বদলে অন্য কোন পরিবর্তন আনা হয় তাহলে এক বছরের কারাদণ্ড হতে পারে বলে জানান শাহদীন মালিক।
পতাকা কীভাবে তৈরি করা হবে এবং কোথায় কোথায় কীভাবে পতাকা ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা ১৯৭২ নামে একটি আলাদা বিধিমালা রয়েছে।
এই বিধিমালা অনুযায়ী, জাতীয় পতাকা গাঢ় সবুজ রঙের হবে। এর পরিমাপ হবে, ১০:৬ অনুপাতে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ নির্ধারণ করে আয়তক্ষেত্রের আকারের সবুজ জমিনে লাল বৃত্ত থাকবে। লাল বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যের এক পঞ্চমাংশ বা পাঁচ ভাগের এক ভাগের সমান ব্যাসার্ধের হতে হবে।
এই লাল বৃত্তের কেন্দ্র হবে, পতাকার দৈর্ঘ্যকে ২০ ভাগ করার পর ৯ম ভাগ থেকে একটি রেখা এবং প্রস্থের অর্ধেক বরাবর স্থান থেকে আরেকটি রেখা টানা হলে- এই রেখা দুটি যে স্থানে মিলিত হবে, সেখানেই হবে ওই লাল বৃত্তের কেন্দ্র।
এছাড়া পতাকা ব্যবহারের বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনাও রয়েছে এই বিধিমালায়।