বাংলাদেশে নিবন্ধিত চা বাগান ও টি এস্টেট রয়েছে ১৬৭টি। ছবি: ইন্টারনেট
খোলাবার্তা২৪ ডেস্ক : দেশে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকায় উৎপাদন যেমন নেয়া হয়েছে নানামুখি উদ্যোগ তেমনি কমানো হয়েছে রপ্তানিও। এরপরও প্রতিবছর চাহিদার তুলনায় প্রায় ১ থেকে ২ কোটি কেজি চায়ের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
এই ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি স্বাভাবিক করতে ২০২৫ সাল নাগাদ চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ কোটি কেজি নির্ধারণ করেছে সরকার।
সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ও চাহিদা মেটাতে পাহাড়ি উঁচু জমির পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সমতল জমিতেও চা চাষ হচ্ছে যা চায়ের মোট চাহিদার ১০% এর বেশি পূরণ করছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ড।
তবে চায়ের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি বাড়াতে উৎপাদন বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের উত্তরাঞ্চরের জেলা পঞ্চগড়ে ১৯৯৬ সালে প্রথম চা চাষের বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়।
এরপর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। তার ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়।
লালমনিরহাটের বাসিন্দা শাহানারা সোমা তার চাকরি সূত্রে চট্টগ্রামে থাকাকালে তিনি পেয়েছিলেন সেখানকার চায়ের স্বাদ।
তারপর পঞ্চগড়ের দেখাদেখি এবং লালমনিরহাটের সীমান্তের ওই প্রান্তে ভারতের অংশে চা চাষ হতে দেখে, ২০০৬ সালে তিনিও নিজ জেলার সমতল ভূমিতে চায়ের আবাদ শুরু করেন।
শুরুতে মাত্র তিন একর জমিতে চাষাবাদ শুরু করলেও এখন তার অনুপ্রেরণায় লালমনিরহাটের ১৫০ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে বলে তিনি জানান।
শাহানারা সোমা জানান, “পাশের ভারতে যদি চা চাষ হয় তাহলে আমাদের মাটিতে কেন হবে না? দেশ হয়তো আলাদা, কিন্তু মাটি আবহাওয়া তো একই, এজন্য আমি চেষ্টা শুরু করি। এলাকার মাটি নিয়ে চা গবেষণা ইন্সটিটিউটে পাঠাই। সেখান থেকেও বলা হয় যে মাটি চায়ের জন্য উপযুক্ত। তারপর থেকে ফলন করে যাচ্ছি।”
বাগান থেকে চা-পাতা তুলে পাহাড়ী পথে কারখানার দিকে যাচ্ছেন চ-শ্রমিকরা। ছবি: ইন্টারনেট
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হল প্রচুর বৃষ্টিপাত ও উঁচু ভূমি। যেন বৃষ্টি হলেও দ্রুত পানি নিষ্কাশন হয়ে যায়।
এ কারণে এতোদিন চা চাষের জন্য পাহাড়ি উঁচু ভূমিই বেছে নেয়া হতো।
ব্রিটিশ আমলে প্রথম বাণিজ্যিক-ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয় সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে ১৮৫৪ সালে। সেই সময় থেকে চায়ের রপ্তানি হতো।
বর্তমানে দেশে ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান ও টি এস্টেট রয়েছে বলে জানিয়েছে চা বোর্ড। এরমধ্যে সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১২৯টি বাগান ও টি এস্টেট।
চা বাগান হতে গেলে ন্যূনতম ২৫ একর জমি লাগে। অন্যদিকে এস্টেট হল চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ও শ্রমিক কর্মচারির মৌলিক সুযোগ সুবিধাসহ চা বাগান।
সে হিসেবে বাংলাদেশে ২ লাখ ৮০ হাজার একর জমিতে নিবন্ধিত বাগানে চা চাষ হচ্ছে। তবে অনিবন্ধিত, ক্ষুদ্র পরিসরের বাগান এর দ্বিগুণ বলে জানিয়েছেন চা সংশ্লিষ্টরা।
পাহাড়ি এলাকায় এতো বছর চা চাষ হয়ে এলেও ২০০০ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ কয়েকটি জেলায় ছোট ছোট বাগানে সেরা মানের চা চাষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
সমতল ভূমিতে উৎপাদিত এই চা, বাংলাদেশে চায়ের মোট চাহিদা পূরণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে বলেও জানান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম।
পঞ্চগড়ে সমতল ভূমির বাগানে চা-পাতা তুলছেন একজন শ্রমিক। ছবি: ইন্টারনেট
চা বোর্ডের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম বলেন, “চায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য আমরা সমতলকে বেছে নিয়েছি। এজন্য আমরা ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় চা চাষের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়েও কেউ যদি ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষ করতে চাইলে আমরা উদ্বুদ্ধ করছি।”
চাষিদের চা চাষের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার মাটি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে সেগুলো চা চাষের উপযোগী কিনা।
যেসব ভূমি উপযুক্ত নয় সেগুলো উপযোগী করে তুলতে কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
চা বোর্ড সূত্র মতে, দেশে প্রতি বছর চায়ের চাহিদা বেড়ে ১০ কোটি কেজিতে দাঁড়িয়েছে। সে অনুযায়ী চায়ের যতো উৎপাদন হচ্ছে তার তুলনায় এক থেকে দুই কোটি কেজি ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ চাহিদা এভাবে বাড়তে থাকায় উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তার সাথে নামিয়ে আনা হযয়েছে চায়ের রপ্তানি।
২০ বছর আগেও যেখানে ১ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা রপ্তানি করা হতো, এখন সেটা কমে ৬ লাখ থেকে ২০ লাখ কেজিতে নেমে এসেছে। এরপরও ঘাটতি মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি চা উৎপাদন করেছে বাংলাদেশ। তবে গত বছর সেটা ১ কোটি কেজি কমে যায়।
এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এবং রপ্তানির গতি ফেরাতে উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন চা গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ আলী।
মোহাম্মদ আলী জানান, উচ্চ ফলনশীল জাতের মাধ্যমে প্রতি হেক্টরে চায়ের উৎপাদন বাড়তে হবে।
সত্তরের দশকে দেশে প্রতি হেক্টরে ৭৩৫ কেজি চা উৎপাদন হতো। সেই উৎপাদন বেড়ে এখন জমিভেদে প্রতি একরে ১৫০০ থেকে ৩৫০০ কেজিতে দাঁড়িয়েছে।
এ ধরনের উচ্চফলনশীল জাত বের করে উপযুক্ত মাটিতে চাষাবাদ শুরু করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন মোহাম্মদ আলী।
এছাড়া পোকামাকড়, আগাছা দমনৎ, সেইসঙ্গে অতিবৃষ্টির মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা উন্নত করার তাগিদ দেন তিনি।
নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত যে পাঁচ মাস শুষ্ক মৌসুম, এই সময়ে চায়ের ফলন ঠিক রাখতে খরাসহিষ্ণু চায়ের দু’টি জাত উদ্ভাবন করেছে চা গবেষণা ইন্সটিটিউট।
এই উচ্চ ফলনশীল ও খরাসহিষ্ণু জাতগুলো চাষিদের কাছে দ্রুত বিতরণ করা গেলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ আলী।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অতিবৃষ্টি সহনশীল জাত উদ্ভাবনের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন আছে।
তবে উত্তরে চা চাষে বিদ্যুতের সরবরাহে সংকটের কথা জানিয়েছেন চা উদ্যোক্তারা।
লালমনিরহাটের শাহানারা সোমার চা চাষের যাত্রা সহজ ছিল না, কারণ লালমনিরহাটের মানুষ চা চাষের সাথে একদমই অপরিচিত।
চায়ের শ্রমিক পেতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে তাকে।
লালমনিরহাটে চায়ের ভবিষ্যৎ কী সেটা নিয়ে শঙ্কা থাকায় কেউ বিনিয়োগ করতেও চায়নি। ব্যাংক ঋণ পেতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
পরে কোনভাবে চা প্রক্রিয়াকরণের মেশিন কিনে একটি কারখানা দাঁড় করাতে পারলেও বিদ্যুতের ভোল্টেজের সমস্যার কারণে মেশিন চালাতে পারছেন না।
এ ধরনের সংকট কাটাতে সরকারে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা, সেইসঙ্গে চা বাগানের নামে লিজ নেয়া জমির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটার মনিটরিং, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা, কম মূল্যে সার-কীটনাশক সরবরাহ, চা চাষিদের প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন চা গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা।