আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) : পলো দিয়ে মাছ ধরা গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। হেমন্তের শেষে আর শীতের শুরুতে কম পানিতে মাছ ধরার উৎসব শুরু হয় গ্রামবাংলায়। বাঙালীর এই ঐতিহ্যের রেশ ধরে সম্প্রতি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বিভিন্ন জলাশয়ে পলো বাওয়ার ধুম লেগেছে।

মুখে-মুখে, হাট-বাজারে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ও মাইকে ঘোষণা দিয়ে শৌখিনদার মৎস্য শিকারীরা পলো নিয়ে ছুটে চলেছেন কালীগঙ্গা নদী ঘেঁষা চরাঞ্চলে, বিভিন্ন বিলে ও চকের হাঁটু জলাশয়ে।

শুক্রবার ভোরে সরজমিন ক্ষিরাই নদীর শাখার অল্প জলাশয়ে পুখুরিয়া এলাকায় দেখা যায়, কমপক্ষে দুই শতাধিক লোকজন পলো বাইচে মাছ শিকারে নেমেছেন।

দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে শোল, বোয়াল, কার্ফু, রুই কাতলা মাছ পলোতে বেশী আটকা পড়ছে। কেউ কেউ আবার ছোট আকৃতির মাছও পাচ্ছেন। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তরা, রাথুরা, বড়টিয়া, দিয়াইল ও শোলধারা-বুতুনী বিলে মাছ ধরা উৎসব হয়েছে। ভোর হতে সকাল ৮টা পর্যন্ত চলে মাছ শিকারের এই উৎসব।

বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শত শত মাছ শিকারী এই উৎসবে মেতে উঠেন। পলোসহ বিভিন্ন ধরনের জাল দিয়ে নানা প্রজাতির মাছ শিকার করে তারা। চলতি মৌসুমে উপজেলার কালীগঙ্গা ও পুরাতন ধলেশ্বরী নদীর ভাটি এলাকার কম পানির কুম, বানিয়াজুরীর তরা, নালী, শোলধারা, তাড়াইল, দিয়াইল, ঘিওরের মাইলাঘী, বড়টিয়া চকের এসব জলাশয়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারসহ প্রায় প্রতি দিনই চলছে পলো দিয়ে মাছ ধরার ধুম।

কলেজ শিক্ষার্থী রাথুরা গ্রামের মোঃ ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, শখের বশে পলো বাইচে আসছি, ছোট-বড় বেশ কয়েকটি মাছ পেয়ে অনেক খুশি হয়েছি। পাশেই আরেক মাছ শিকারী বারেক মিয়া পেয়েছেন বড় আকৃতির একটি বোয়াল মাছ।

পলো বাইচের অন্যতম আয়োজক শোলধারা গ্রামের মজিবর মাষ্টার জানান, বিশ একরের শোলধারা বিলের এই জলাভূমিতে শত বছর ধরে পলো দিয়ে মাছ ধরা উৎসব চলে আসছে। প্রতি বছরই অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামবাসীর উদ্যোগে এই আয়োজন করা হয়।

আশেপাশের মাছ শিকারীরা এই দিনের অপেক্ষায় থাকে। মধ্যরাতের পর থেকে শোলধারা বিলে জড়ো হতে থাকে শিকারিরা।

পলো বাইচে অংশ নেওয়া আরো অনেকে জানান, পলো বাইচ দিয়ে মাছ শিকার করার মজাই আলাদা। কারো পলোর নিচে একটি মাছ পড়লে সবাই ঝাকর (চিৎকার) দিয়ে সেই মাছটি ধরতে সবাই সহযোগিতা করেন। পলো বাইচে আশপাশের কয়েক ইউনিয়ন ছাপিয়ে অন্য জেলা থেকেও মানুষজন পূর্ব ঘোষিত দিনে অংশগ্রহণ করে। শত শত লোকের একদিক থেকে সারি বেঁধে চিৎকার করে ডাক দিতে দিতে মাছ ধরা।

সারিবদ্ধভাবে পলো ফেলে সকলে সামনের দিকে আগ্রসর হওয়ায় মাছগুলো পেছনের দিকে যেতে না পেরে সারিবদ্ধ লোকদের সামনে দিয়ে লাফালাফি করতে করতে পেছনের দিকে ছুটতে থাকে।

এ সুযোগে শিকারীরা বড় বড় মাছগুলো লক্ষ্য করে তাদের পলো নিক্ষেপ করে। কোন মাছ পলোতে আটকা গেলে মাছটি পলোর ভেতর লাফালাফি করতে থাকে, আর শিকারিরা পলোর উপর দিকের খোলা অংশ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মাছটি ধরে জালের থলি বা রশি দিয়ে কৌশলে আটকে কোমড়ে বেঁধে রাখে।

পলো বাওয়া দলের পেছনে পেছনে কিছু লোক ছিপ জাল, ঠেলা জাল ও ঝাকি জাল দিয়ে লাফালাফি করে পালিয়ে যওয়ার চেষ্টারত ছোট ছোট (পুঁটি, চাপিলা, লাঠি, চিংড়ি ইত্যাদি) মাছগুলো ধরেন। পলো বাইচের সৌখিন মাছ শিকারী ইসলাম খান বলেন, ভোর ৫টায় শুরু হয় মাছ ধরা।

বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বানিয়াজুরী ইউনিয়নের রাথুরা ও জাবরা মৌজার বিশাল জলাশয়ে প্রায় এক হাজার মাছ শিকারী পলো, ধর্মজাল, দোলা জাল, ঝাঁকি জাল ও ফাঁস জাল দিয়ে মাছ শিকারের উৎসবে মেতে উঠে। রুই, বোয়াল, শিং, কৈ, শোলসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছেলে-বুড়ো থেকে নানা বয়সী মানুষ।

নয়াচর গ্রামের গ্রামের মাছ শিকারী মোঃ দুলাল মিয়া বলেন, তিনি গত দশ বছর ধরে প্রতিবারই এই বিলে মাছ ধরা উৎসবে যোগ দেন। এবার পলো দিয়ে তিনি একটি মাঝারি আকৃতির বোয়াল মাছ শিকার করেছেন। জাবরা গ্রামের মোঃ শাহিন আলম জানান, গত ৫ বছর ধরে তিনি এই বিলে নিয়মিত মাছ ধরেন। বছরে একবার মাছ ধরা উৎসব হয়।

এ সময় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের জাল নিয়ে আসে। আগে মাছ ধরার প্রতিযোগীতা হতো। ধরা শেষে বড় কৃতি ও বেশী মাছ পাওয়াদের পুরস্কার দেওয়া হতো। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে আগের মত মাছ মিলছে না। তবে মানুষের উৎসাহের কমতি নেই।

এদিকে বাইচে অংশ নিতে বিভিন্ন বয়সী মানুষ পলো কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। অন্য সময় সাধারন একটি পলো ২৫০/৩৫০ টাকা বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্তু বাইচের সময় তিনগুন বেশি দাম দিয়েও পলো কিনতে কাড়াকাড়ি লেগে যায়।

ঘিওরের বানিয়াজুরী বাসষ্ট্যান্ডে পলো বিক্রেতা অনীল বাবু বলেন, বাইচের আগের দিন ৫০ পিচ পলো নিয়ে আসছি। এক ঘন্টার মধ্যেই সব শেষ। দামও পেয়েছি ভালোই।