আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) : রঙিন বাতিতে আলো ঝলকানি। বসন্তের মৃদু শৈত্য বাতাসে ভেসে আসছে ঢাকঢোল, সাউন্ড সিস্টেমে বিয়ের গান আর সানাইয়ের মিহি সুর। আঁলপনাময় মন্দিরের সিঁড়ি। আত্মীয়-স্বজন, এলাকাবাসী আর অতিথি মিলে প্রায় হাজার দুয়েক লোকের সরগরম। উৎসবমুখর পরিবেশ। মন্দিরে চলছে বিয়ের আয়োজন।

সাজানো হয়েছে বর-কনে। কন্যা সম্প্রদানের জন্য প্রস্তুত পরিবারের লোকজন। বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য এসেছেন পুরাহিত। অতিথির প্রীতিভোজের জন্য চলছে রান্নাবান্নার বিশাল আয়োজন। তাদের বসার ব্যবস্থা ছিল শামিয়ানা টাঙানো ডেকোরেশন করা চেয়ার টেবিল। অপেক্ষা শুধু শুভলগ্নের।

গত শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে ঘনিয়ে এল সেই লগ্ন। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সম্পন্ন হলো বিয়ে। হলো শুভদৃষ্টিও। কনের মা লক্ষী রাণী সরকার অশ্রসিক্ত নয়নে কন্যা সম্প্রদান করেন। আদরের কন্যাকে বিদায় দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন উপস্থিত সবাই। এ সময় আনন্দাশ্রুতে চোখ ভেজালেন বরের পিতা মেঘলাল দাসও।

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বড়টিয়া গ্রামে একটি বিয়ে উপলক্ষে গত শুক্রবার রাতে এমন পরিবেশ বিরাজ করছিল। বিয়ে উপলক্ষে এত সব আয়োজন থাকলেও পাত্রপাত্রী হিসেবে বাস্তবে ছিলেন না কোনো ছেলেমেয়ে।

বড়টিয়া কালী মন্দির প্রাঙ্গণে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা দুটি বট ও পাকুড় গাছের ধুমধাম করে বিয়ে দিতে গিয়ে এত সব আয়োজন করা হয়। আর আলোচিত এই বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষের ঢল নামে।

ভাত, বেগুন ভাজি, সবজী, মুরগীর মাংস, মাছ ভাজি, ডাল ও মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। এতে হাজার দুয়েক মানুষ বিয়ের দাওয়াত খেয়ে তুলেছেন তৃপ্তির ঢেঁকুর।

এ সময় কয়েক অতিথি উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন ধুতি ও কাপড়। অনুষ্ঠান চলে রাত দুইটা পর্যন্ত।

আয়োজকদের অন্যতম ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাবু নন্দ দাস বলেন, আনন্দ উৎসবের পাশাপাশি এটি পূণ্যের কাজ। অনেক দিনের সাধ ছিল। এলাকাবাসীর সম্মতি ও সহযোগিতায় অবশেষে বট পাকুড়ের বিয়ে সম্পন্ন হলো।

বর-কনেকে স্নান করানো, শীল ডেকে ক্ষৌরকর্ম, সিঁদুর দেয়া ও ১৫টা শাড়ি পরিয়ে সাজানো হয়। এসব কাজে তদারকী করেন (আয়ো গ্রুপ প্রধান (কন্যার সহকারী) দিপালি রানি দাস।

বিয়ে উপলক্ষ্যে বরযাত্রীরা এলাকায় প্রায় ২ কিলোমিটার রাস্তা ঘুড়ে ব্যান্ড পার্টির তালে তালে নেচে গেয়ে আনন্দ করেন। শুক্রবার রাতে সেখানে নারায়ণ পূজার পর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।

বট গাছকে ‘বর’ ও পাকুড় গাছকে ‘কনে’ ধরে বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের আগে বটের নাম রাখা হয় সূর্য শেখড় আর পাকুড়ের নাম হয় ‘স্বর্ণলতা।

এই বিয়েতে বটের বাবা হয়েছিলেন মেঘলাল দাস ও এলাকার একাংশ। পাকুড়ের বাবা হয়েছিলেন নন্দ দাস, তাঁর সাথে ছিলেন এলাকার বাকি অংশের লোকজন।

বড়টিয়া কালী মন্দির এলাকায় প্রায় শতাধিক দাস সম্প্রদায়ের বসবাস।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় শত বছরেরও বেশি পুরনো কালি মন্দির প্রাঙ্গণে ৬০ বছর আগে লাগানো হয়েছিল বট গাছ। শাখা প্রশাখায় প্রকান্ড রুপ নিয়েছে। আর প্রায় ২০ বছর পূর্বে বটের পাশাপাশি রোপণ করা হয় একটি পাকুড় গাছ, সেটিও বেশ জায়গা জুড়ে অবস্থান নিয়েছে।

সরজমিন দেখা যায়, বিয়ে ঘিরে বর-কনের পাশে ছাদনাতলা সাজানো হয়। ছাদনাতলায় মঙ্গলঘট বসিয়ে শুরু হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। টাঙানো হয়েছিল রঙিন সামিয়ানা। হিন্দু রীতি অনুসারে কলাগাছ দিয়ে সাজানো ছিল বিয়ের আসর। গানের তালে তালে চলছে বর ও কনে পক্ষের লোকজনের নাচানাচি, খুঁনসুটি। পাশেই ব্যস্ত রাঁধুনিরা। মোটকথা সত্যিকারের বিয়ের উৎসবে যা যা হয়ে থাকে তাই হয়েছে। শুধু বর-কনে দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গাতে।

এরপর রাত ৯টার দিকে দলে দলে লোক আসে বরযাত্রী হয়ে। গেটে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হয় বাতাসা ও সন্দেশ খাইয়ে। জমে ওঠে বিয়ের অনুষ্ঠান। বর-কনের চারপাশ ঘিরে গল্পে মেতে ওঠেন অতিথিরা। বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে আসা (দাওয়াতি মেহমান) আড়তি সরকার (৪৫) বলেন, এ গাঁয়ের মেয়ে আমি। আমার বিয়ে হয়েছে শিবালয় উপজেলায়। বট পাকুড়ের এই বিয়েতে যে উৎসবমুখর পরিবেশ আর আপ্যায়নের সুব্যবস্থা দেখলাম।আমার বিয়েতেও ছিল না এমন আয়োজন। দুই মেয়ে নিয়ে নিমন্ত্রণ খেতে আসছি। আমরা খুব খুশি।

অপর মেহমান ঘিওর সদরের দূর্লভ দাস বলেন, তৃপ্তিসহকারে খেয়েছি, অনেক আনন্দ হয়েছে। আনন্দ উৎসবের পাশাপাশি এটি একটি পূণ্যের কাজ।

মন্দির কমিটির সভাপতি বিকাশ চন্দ দাসের সভাপতিত্বে বিয়ে ও পারিপার্শিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বরটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ সামছুল আলম রওশন। বাবুল দাসের সঞ্চালনায় এসময় আরো বক্তব্য রাখেন মানিকগঞ্জ ভক্ত সংঘের উপদেষ্টা বাবু নন্দ দাস, শেফালি সাহা প্রমুখ।

স্থানীয় বরটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ শামসুল আলম রওশন বলেন, হিন্দু শাস্ত্রে আছে বট-পাকুড় পাশাপাশি থাকলে তাদের বিয়ে দিতে হয়। রীতি চরিতার্থ করার স্বার্থেই এ আয়োজন। বট-পাকুড় এখন আজীবন এভাবে পাশাপাশি থাকবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।