আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জের ঘিওরে অনুষ্ঠিত হলো প্রায় তিনশত বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘জামাই মেলা’। গতকাল বুধবার উপজেলায় পয়লা ইউনিয়নের বাঙ্গালা স্কুল মাঠে দোল পূর্ণিমায় এই মেলা বসে। স্থানীয়ভাবে এ মেলাকে অনেক নামেই ডাকা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জামাই মেলা, বৌ মেলা, বাঙ্গালা মেলা বা মাছের মেলা।

স্থানীয় বাঙ্গালা মুক্তা সংঘের আয়োজনে এ মেলার সময় পুরো ইউনিয়ন এলাকার মেয়ে আর জামাইকে দাওয়াত করে আনা হয়। তারপর মেলা থেকে জামাইরা বড় বড় মাছ কিনে, সেই মাছ শশুড় বাড়ির লোকজনকে খাওয়ানো হয়। এটা এখানকার দীর্ঘ দিনের প্রচলিত নিয়ম। এ কারণে এটাকে ‘জামাই মেলা’ বলা হয়। এরপর মেয়ে জামাতাদের শশুড় বাড়ির পক্ষ থেকে দেয়া হয় আর্কষনীয় বিভিন্ন পুরষ্কার। যেমন গরু, মহিষ, আসবাবপত্র, স্বর্ণালংকার ইত্যাদী।

মেলা হয় দুই দিনব্যাপী। দ্বিতীয় দিনকে বলে ‘বৌ মেলা’। এদিন কেবল বিভিন্ন গ্রামের নববধূরা এবং স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসা মেয়েরা তাদের স্বামীদের সঙ্গে মেলায় আসেন। স্বামীদের নিয়ে সারাদিন তারা মেলায় ঘোরাঘুরি করেন ও সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটা করেন। মেলায় কেবল যে মাছ পাওয়া যায় তা নয়, মাছ ছাড়াও কাঠের আসবাবপত্র, বাঁশ ও বেতসামগ্রী, লৌহজাত দ্রব্য, ফলমূল, নানা ধরনের মিষ্টি ও মিষ্টিজাত দ্রব্য এবং চুন পাওয়া যায়। এখানকার মিষ্টির আকারও বিরাট বড়। একেকটির ওজন এক থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত।

স্থানীয় বাঙ্গালা ডাঃ গণি-সাহেরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দুলাল চন্দ্র সরকার বলেন, এটি কেবল একটি মেলা নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। মেলায় থাকে বড় বড় আর লোভনীয় মাছের বিশাল সংগ্রহ, বিকিকিনি, সংসারের যাবতীয় উপকরণ, বিনোদনের জন্য সার্কাস, নাগরদোলা, গান ইত্যাদি। কিন্ত এসবকিছু ছাপিয়ে হাজারো মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় দুদিনের এই মেলা।

করোনার কারণে গত দুই বছর মেলা বন্ধ থাকলেও এ বছর উৎসবমুখর পরিবেশে মেলা বসেছে। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ঘোড়দৌড়। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিযোগিতার জন্য এই মেলায় বাহারি রকমের ঘোড়া আসে। ঘোড়ার দৌড় দেখার জন্য উৎসুক জনতা মেলায় ভিড় জমায়। তাছাড়া মাছ, মিষ্টি, কসমেটিক, বিভিন্ন খেলনা, ক্রয়-বিক্রয় চলে মেলা শেষ হওয়ার পরের দিন পর্যন্ত।

মেলা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, এ মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-ঘোড়া দৌড়, শিশু কিশোরদের ক্রীড়া, ও সাইকেল রেস। কাঠের আসবাবপত্রসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র পাওয়া যায় এই মেলায়। বুধবার সরজমিন বিকেল ৪ টায় গিয়ে দেখা যায়, মেলায় প্রবেশমুখ থেকে আরম্ভ করে পুরো মেলা আযঙনা জুড়ে মানুষের ভীড়। এই ভীড় আশেপাশের প্রায় দেড় কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে। মাছ গলিতে দেখা যায়, মেলায় পাঁচ থেকে বিশ কেজি ওজনের মাছের সমারোহ। শতাধিক জেলেরা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ডালঅয় সাজিয়ে রেখেছেন। বিক্রিও হচ্ছে ব্যাপক। এর মধ্যে নদীর বাঘাইর, আইড়, বোয়াল, কাতলা, পাঙ্গাস, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, চিতল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেচাকেনা হয়। তবে, চাষের বিভিন্ন ছোট বড় আকারের মাছও পর্যাপ্ত পাওয়া যায়।

মেলায় আসা কসমেটিক ব্যবসায়ী রিপন হোসেন জানান, করোনার কারণে গত দুই বছর এই মেলায় আসতে পারিনি। এবার আশা করছি- ব্যবসা ভালো হবে। মাটির তৈজসপত্র বিক্রেতা অনিল পাল (৬২) বলেন, আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই মেলায় মাটির জিনিস পত্র বিক্রি করতে আসি। বাবার মুখে শুনেছি তিনি ও আমার দাদাও এই মেলায় আসতেন।

মেলায় কথা হয় পয়লা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য চাঁন মিয়ার সাথে। তিনি জানালেন, আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১০ বছর আগে। প্রতিবছর এই মেলায় মেয়ে -জামাতাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসি, তাদের উপঢৌকন দেই। এবছর মেয়ের জামাই এর জন্য একটি গাভি ক্রয় করেছি উপহার দেয়ার জন্য। যার যার সাধ্য মতো উপহার দিয়ে থাকে।

এটিই আমাদের এলাকার ঐতিহ্য। স্ত্রী, শ্যালিকাদের নিয়ে মেলায় ঘুরতে আসা প্রবীণ জামাতা মোঃ রমজান আলী (৫২) বলেন, আমি বাঙ্গালা গ্রামে ৩০ বছর আগে বিয়ে করার পর থেকে এই মেলায় আসি। অনেক আনন্দ হয়। এই মেলাটিই অনুষ্ঠিত হয় আমাদের (জামাতা) জন্য।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও বাঙ্গালা মুক্তা সংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোঃ হারুন অর রশিদ জানান, এ মেলা কবে থেকে শুরু হয়েছে, তার সঠিক দিনক্ষণ জানা যায়নি। তবে, এই মেলা নিয়ে একাধিক মিথ রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র মতে জানা যায়, বাঙ্গালার মেলাটি ৩শ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে। এটি জেলার অন্যতম প্রাচীনতম মেলা। এই দিনের জন্য এলাকাবাসী মুখিয়ে থাকেন।

ঘিওর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব জানান, এই মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন। এর সার্বিক নিরাপত্তায় পুলিশি টহল চলমান আছে।