সোয়েব মোহাম্মাদ
“আজ অফিস ছুটি হওয়ার পর কেন যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেলাম। এখন ফোনে চার পার্সেন্ট চার্জ আছে, আলো জ্বালাবো কি করে!”
এমন কথা বলতে বলতে মাঝবয়সী আজাদ সাহেব হাঁটছিলেন। রাস্তা পুরো অন্ধকার, বিদ্যুৎ শূন্য পুরো শহর।স্ট্যান্ডে থাকা দুই চারটে অটোরিকশাকে বলছিলেন বড়াইল পাড়ায় যাওয়ার কথা। তারা তিন গুণ ভাড়া দাবি করায় বাধ্য হয়ে বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশে হাঁটা ধরলেন। এখান থেকে বাসা খুব দূরে নয়, বেশি হলে এক কিলোমিটার।
গত কয়েকদিন যাবৎ বিদ্যুতের খুব যাওয়া-আসা চলছে। হিসাব করতে গেলে দিন-রাতে সাত থেকে আট ঘন্টা থাকে আর বাকি সময় উধাও। শুধু যে এই এলাকাতে হচ্ছে এমন নয় সারা বাংলাদেশ জুড়ে এই অবস্থা।
এই বিদ্যুৎ যাওয়াতে কষ্টটা ভোগ করতে হয় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষদের। ধনিরা আইপিএস, জেনারেটর দিয়ে পুষিয়ে নেয়।
উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা তো আর সেই কষ্টটাকে বুঝবে না, ওরা থাকে উঁচু বিল্ডিংয়ে; রঙিন দেয়ালে ঝুলানো এসির ঠাণ্ডা বাতাসে। ওখানে বিদ্যুৎ না থাকলেও কিছু যায় আসে না, সব ধরনের ব্যবস্থা ওনাদের আছে।আমাদের মতো লোকের দুঃখই বা বুঝবেন কি করে!
জ্যোস্না নেই, তবু মহাকাশের আলোয় চারপাশ অতি ঝাপসা; তবে হেঁটে যাওয়ার মতো যথেষ্ট। আজাদ সাহেব নিমাইপুর পৌরসভার বাসিন্দা। শহরের পাশে যে চারটা গ্ৰাম আছে, ওগুলো তার অন্তর্গত। শহরের রামপাড়া থেকে সামান্য দক্ষিণ পাশে এ গ্ৰাম অবস্থিত।
আজাদ সাহেব হাঁটতে হাঁটতে রামপাড়া পাড় করে কালী শশানের সামনে এসে থুমকে গেলেন। শহরের অতি নির্জন এলাকায এই শশান। আশ-পাশে কোন বাড়ী ঘর নেই। সামনে ছোট্ট কালী মন্দির পাড় হলেই শশানের এড়িয়া। মানুষের মুখে শোনা- কালী শশানের অনেক অলৌকিক ঘটনা মনে পড়ে তার বেশ ভয় লাগতে শুরু করেছে। জায়গাটা দিনের বেলায় যতোটা নির্জন থাকে রাতের বেলায় তার দশগুণ নির্জনে পরিণত হয়। এর উপর আবার কারেন্ট বিহীন নগর, তাই ভয়টা একটু বেশি ই বেড়েছে। ভয় বাড়ালেও করার কিছু নেই, যেতে তো হবেই। বাড়ি পৌঁছাবার জন্য এছাড়াও আরো একটি রাস্তা আছে, কিন্তু ওই রাস্তা ধরে হাঁটলে বাড়ি যেতে বেশি সময় লাগবে। তাই মনে ভয় রেখে এ রাস্তা ধরে হাঁটছেন আজাদ সাহেব।
কালী মন্দির পাড় হয়ে শশানের ধার ঘেঁষে মনে ভয়ে চেপে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় হাঁটছিলেন। একটু দূরে সাদা রঙের পোশাক পরিহিত কোন শরীরের আভা দেখতে পেয়ে ভয়ে থমকে গেলেন আজাদ সাহেব। তিনি মানুষের মুখে যতো ধরনের ঘটনা শুনেছেন তার প্রায় সব কিছুতে সাদা কাপড় পরিহিত অদৃশ্যের অস্তিত্ব ছিল।
আজাদ সাহেব ভয়ে ভয়ে গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কে? ওখানে কে দাঁড়িয়ে আছে?”
সামনে থেকে বৃদ্ধা কন্ঠস্বরে উত্তর ভেসে আসলো, “কন্ঠটা চেনা চেনা লাগে, আজাদ বাবা নাকি?”
“হ্যাঁ, আমি আজাদ। কিন্তু আপনি কে?”
“আমি রে আদম আলী, তোর বড়াব্বা। বোকা ছেলে নিজের বড়াব্বাকে চিনতে পারছিস না।” এই বলে হো-হো করে হাসলেন।
আজাদ সাহেব দীর্ঘ শান্তির শ্বাস ত্যাগ করলেন। এরপর সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “আরে বড়াব্বা যে। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
ভয়ের কি আছে, ওরা সব আত্মা। একসময় আমাদের মতো মানুষ ছিল। তখন কি তাদের দেখে ভয় লাগতো? ভেবে দেখ একদিন তুই মরা যাবি তখন লোকে তোকে ও ভয় করবে। হু হু হু….
আজাদ সাহেব বড় চাচাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “বড়াব্বা এইসব কথা এখন বলবেন না। এখন বলেন, এই রাতের বেলায় এখানে কি করছেন?”
আর বলিস না। তোর বড়াম্মার খুব অসুখ করেছে, তাই শহরে ঔষধ নিতে গিয়েছিলাম সেখান থেকে ফিরছি।
ওহ, তাহলে চলেন বাড়ি ফেরা যাক।
হু.. চল তাহলে।
নিরবে দু’জনে হেঁটে চলছে। রাতের নয়টার পর এই রাস্তায় অটোরিকশা যাওয়া-আসা করে না। একদিকে শশান, আরেক দিকে যায়গাটি নির্জন হওয়ায় নেশাখোরের উৎপাত। মাঝেমধ্যে মধ্যে ছিনতাই হতে শোনা যায়। আজাদ সাহেবের যেমন ভুতের ভয় মনে বেঁধে আছে ঠিক তেমন চোর-বাটপারের ভয় ও কাজ করছে। কাছে এগারোশো টাকা আর দামি টাচ ফোন।
পথে হাঁটার সময় দুজনে নীরব থাকার পর আদম আলী সে নীরবতা ভেঙে বললেন, “আজাদ, মৃত্যু কতো সহজ তাই না। যখন তখন শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে অদৃশ্য আত্মা। নিশ্চিত মৃত্যু নিয়ে আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস।”
তা ঠিক বলছেন।
জানিস আজাদ, “কখনো ভাবিনি এভাবে মৃত্যু হবে।”
আজাদ কথাটা শুনে থমকে দাঁড়ালেন, এরপর জিজ্ঞেস করলেন, “কিসের মৃত্যুর কথা বলছেন? ঠিক বুঝতে পারলাম না!”
আমার মৃত্যুর কথা বলছি খোকা। কিছুক্ষণ আগে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড পাড় হওয়ার সময় আমার শরীরের উপর বয়ে যায় তীব্র গতির ঢাকার কোচ। চ্যাপ্টা দেহ, রক্ত মাখা শরীর পড়ে আছে রাস্তার পাশে। আমার দেহটাকে ঘিরে কয়েকটা দিনমজুরি আর রিকশাওয়ালা।
আজাদ সাহেবের কাছে কথাগুলো ভাড়ি অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো। হা হা হা করে হেসে বলতে লাগলো, “চাচা আপনার বয়স তো কম হলো না, তাই বলে সবার মতো আমার সাথে ও মজা করবেন।”
কথা না ফুরাতে ফোন বেজে উঠলো। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলেন বাবা ফোন করেছে। আজাদ সাহেব ফোন ধরেতেই ওপাশ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠ ভেসে আসলো।
আজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “আব্বা কান্নাকাটি কেন করছেন? কি হয়েছে?”
তোর বড়াব্বা এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে।
আব্বা আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। বড়াব্বা তো আমার পাশে আছেন!
বিদ্যুৎ চলে এসেছে, রাস্তার দু’পাশে থাকা সাদা বাল্বের আলোয় ঝকঝকে রাস্তা। তিনি বাঁ পাশে তাকিয়ে মানসিকভাবে শক পেয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার বাঁ পাশে কেউ নেই, সামনে পিছনে কেউ কোথাও নেই। সে সময় তার মুখের পাশে দিয়ে গরম বাতাস প্রবাহিত হলো। তার মনে হলো তার বড়াব্বা বলে গেল, “ভালো থাকিস আদরের খোকা।”
আজাদ সাহেব চশমা খুলে নিজের চোখ দুটো মুছতে মুছতে রওনা হলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।