বগুড়া অফিস : সমুদ্রের মাঝামাঝি গিয়ে বিশাল ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে গিয়েছিল কিশোর রাব্বী। ছেলেকে দেখতে না পেয়ে জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়েছিল রিস্কিউ বোটে থাকা বাবা আলালুর রহমান তিব্বতের। একটু পর ছেলেকে পানির উপরে ভাসতে দেখে খুশিতে দু’চোখের কোণা ভিজে যায় তার। মাত্র ৩ ঘন্টা ২০ মিনিটে ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেয়া ১৩ বছর ৬ মাস বয়সী রাব্বীর সাফল্যের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বাবা তিব্বত।
আলালুর রহমান এক সময় জাতীয় পর্যায়ের সাঁতারু ছিলেন। জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পদকও জিতেছিলেন। সাঁতারের নেশায় অর্থ উপার্জনের সবকিছু ত্যাগ করে দিনরাত পড়ে থাকতেন সুইমিংপুলে। বগুড়া জেলা সুইমিংপুলের সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেশ কিছু দিন। এরপর সুইমিংপুল বন্ধ হয়ে গেলে বেকার হয়ে পড়েন তিনি। দুই মেয়ে, এক ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে স্থানীয় একটি বাসের টিকেট কাউন্টারে চাকরি নেন। পাশাপাশি দিনের শুরুতে বাড়ীর পাশে একটি মাদ্রাসার পুকুরে এলাকার ছেলেদের সাঁতার শেখান। প্রতিদিন বাবার সাথে পুকুর পাড়ে বসে পাড়ার ছেলেদের সাঁতার কাটতে দেখে রাব্বীর মনেও সাঁতার শেখার সখ জাগে। ছেলের আবদারে বাবা সাঁয় দিলেও মা আমেনা বেগম ছোট্ট ছেলেকে পানিতে নামতে দিতে চাননি। কিন্তু ছেলের জিদের কাছে পরাজিত হন তিনি।
২০১৫ সালে যখন রাব্বীর বয়স মাত্র ৮ বছর সে সময় তার সাঁতার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী মধ্যপাড়ার পুকুরই রাব্বির জীবনের প্রথম সুইমিংপুল। এই পুকুরেই প্রতিদিন সকালে বাবার তত্ত্বাবধানে কয়েক ঘন্টা কঠোর অনুশীলন চলতে থাকে রাব্বীর। একপর্যায়ে ছেলের মাঝে অসাধারণ প্রতিভার সন্ধান পান পিতা। তিনি ছেলের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য চাচাতো ভাই সাঁতার প্রশিক্ষক মাসুদ রানার শরণাপন্ন হন। বগুড়া পৌরপার্কের পুকুরে চাচা মাসুদ রানার কাছে সাঁতারের অনেক কৌশল শেখে রাব্বী।
এভাবেই ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করতে থাকে সে। স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে একের পর এক সাফল্য পায় রাব্বী। পুলে নামলেই সাফল্য এসে ধরা দেয় তার। অবশেষে ২০১৯ সালে জাতীয় শিশু একাডেমী আয়োজিত জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে স্বর্ণ পদক জয় করে রাব্বী। রাস্ট্রপতি মুহাম্মদ আব্দুল হামিদ তার গলায় সোনার মেডেল পরিয়ে দেন। জীবনে প্রথমবার সোনা জেতার পর নিজেকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করে রাব্বী। অবশেষে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ এসে হাতছানি দেয় তাকে।
গত ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ১৫তম বাংলা চ্যানেল সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় রাব্বী। বয়স কম হওয়ায় আয়োজকরা শুরুতে তাকে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ী রাব্বীর মানসিক দৃঢ়তা দেখে অবশেষে আয়োজকরা তাকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেন। ওইদিন সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহ্পরীর দ্বীপ জেটি থেকে শুরু হয় ফরচুন বাংলা চ্যানেল সাঁতার-২০২০। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া ৪২ জন সাঁতারুকে পিছনে ফেলে মাত্র ৩ ঘন্টা ২০ মিনিটে বাংলা চ্যানেল অতিক্রম করে প্রথম হয় রাব্বী। এর আগে এত কম বয়সে আর কোন সাঁতারু বাংলা চ্যানেল অতিক্রম করতে পারেনি।
রাব্বী স্থানীয় সুবিল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। তার এই সাফল্যে খুশিতে আত্মহারা তার পরিবার। মেঝো বোন অদ্রিতা জানায়, ছোট ভাইয়ের সাফল্যে তারা খুব খুশি। ভাইয়ের আরও সাফল্যের জন্য তারা সকলের দোয়া প্রার্থী।
মা আমেনা বেগম বলেন, “গভীর সমুদ্রে ছেলের সাঁতারের কথা শুনে খুব ভয়ে ছিলাম। সারাদিন আল্লাহকে ডেকেছি। দোয়া-দরুদ পড়েছি। ছেলের সমুদ্র জয়ের খবর শোনার পর নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমার ছেলে আরও অনেক দূর যেতে চায়। সে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে সোনা জিততে চায়। আমার বিশ্বাস সে পারবে।”
রাব্বীর বাবা সাঁতার প্রশিক্ষক আলালুর রহমান তিব্বত বলেন, “আমার ছেলেকে নিয়ে আশাবাদী ছিলাম। মনের ভিতরে ভয় থাকলেও আশা ছিল সে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিতে পারবে। সরকারের অনুমতি এবং সহযোগিতা পেলে আমার ছেলে একদিন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”
বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, কিশোর সাঁতারু রাব্বী শুধুমাত্র বগুড়া কিম্বা বাংলাদেশের সম্পদ নয়। সে এখন দক্ষিণ এশিয়ার সম্পদ। এই কিশোর সাঁতারুকে ঠিকমত পরিচর্যা করলে সে একদিন দেশের জন্য অনেক সম্মান বয়ে আনতে পারবে। আজকের কিশোর রাব্বী একদিন অলিম্পিকে সোনা জিতে বাংলাদেশের মর্যাদাকে সারাবিশ্বে সমুন্নত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।