নাসির আহমেদ কাবুল
নীতিশ বাবুর নতুন চাকরি। মফস্বল শহরে প্রথম পোস্টিং তার। ব্যাচেলর নীতিশ বাবু ব্যাগ ও একটি ফোল্ডিং বিছানা নিয়ে চাকরিতে যোগদানের জন্য রওয়ানা হলেন। দূরের পথ। রাত গভীর। ট্রেন ছুটে চলছে গন্তব্যে। বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দে রাতটা তখন ভয়ানক রূপ নিয়েছে।
নীতিশ বাবু শেষ স্টেশনের যাত্রী। রাত দশটার মধ্যেই কেবিন থেকে সহযাত্রী সবাই একে-একে নেমে পড়লে নীতিশ বাবু একাই পুরো রুমটা দখল করলেন। মনে মনে উচ্ছ্বসিত হলেন একা একটি রুম পেয়ে। ফুরফুরে মেজাজে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন নীতিশ বাবু। বিদ্যুৎ চমকের আলোয় ভেজা গাছপালা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না তার। তবে মাঝে-মাঝে শিয়াল আর নিশাচর পাখির ডাক শুনতে পেলেন তিনি।
নীতিশ বাবু বই পড়তে ভালোবাসেন। বিশেষ করে রহস্য গল্প তার প্রিয় বিষয়। মাঝে-মধ্যে টুকটাক লেখেনও তিনি। বেশ কয়েকটি দৈনিকের সাহিত্য পাতায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এ কারণে গা-ছমছম পরিবেশ তার খুব প্রিয়। এ ধরনের পরিবেশে তিনি গল্পের নতুন প্লট খুঁজে পান। তিনি ভাবলেন আজ আর ঘুমাবেন না তিনি। জেগে থাকবেন এবং বই পড়েই রাতটা কাটিয়ে দেবেন।
ট্রেন ছুটে চলছে। বইয়ের মধ্যে ডুবে আছেন নীতিশ বাবু। পড়তে-পড়তে কখন যেন তার দু-চোখে ঘুম নেমে এলো। বুঝি-বা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। হঠাৎ কোথায় যেন বিড়ালের ‘মিঁউ’ ডাক শুনতে পেলেন নীতিশ বাবু। ঘুম থেকে জেগে উঠলেন তিনি। খুব বিরক্ত হলেন। আবার চোখ বুজতে চেষ্টা করলেন। আবারও ঘুমের ঘোরে বিড়াল ডেকে উঠলো ‘মিঁউ-মিঁউ-মিঁউ-মিঁউ… ’।
নাহ, আর পারা যাচ্ছে না। বিড়ালটাকে তাড়াতে না পারলে স্বস্তি পাওয়া যাবে না এতোটুকু। চারদিকে তাকালেন তিনি। কিন্তু কোথাও কোন বিড়াল দেখতে পেলেন না নীতিশ বাবু। মনে-মনে ভাবলেন, ট্রেনের বন্ধ কামড়ায় বিড়াল আসবে কোত্থেকে? নিশ্চয়ই তিনি ভুল শুনছেন। হয়তো হেলুসিনেশন। ডাক্তারের পরামর্শে ট্রাঙ্কুলাইজার জাতীয় ওষুধ নিয়মিত খেতে হয় তাকে। হেলুসিনেশন ওই ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আবারও পড়ায় মন দিলেন নীতিশ বাবু।
সময় বয়ে যায় ঘড়ির কাঁটায়। নীতিশ বাবু গল্পের মধ্যে ডুব দেন। ‘‘…একদিন একটি ভাঙ্গাচোরা বাড়িতে এক সাংবাদিক ভূত দেখবেন বলে রাতের বেলা উপস্থিত হলেন। বাড়িটা খুব পুরনো ও সেকেলে। তবে একজন কেয়ারটেকার আছে বাড়ির জন্য। কে তাকে নিয়োগ দিয়েছে, কেউ তা জানে না। তবে নিজেকে সে বাড়ির কেয়ারটেকার বলে পরিচয় দিয়ে আসছে অনেক বছর যাবত। নীচতলায় ছোট্ট একটি কক্ষে তার বাস। লোকটিকে দেখে বয়স কতটা আন্দাজ করা কঠিন। মাথায় চুল নেই, দাড়ি-গোফ নেই। চোখ দুটি কোটরের মধ্যে খুঁজে পাওয়া কঠিন। একপাটি দাঁত জং ধরা। হি-হি করে হাসতে-হাসতে এগিয়ে এসে সাংবাদিককে শুধালো, সাহেবের বুঝি ভূত দেখার খুব সখ?
সাংবাদিক বললেন, না-না তেমন কিছু নয়।
লোকটি বললো, তাহলে ভূতের বাড়িতে এলেন কেন?
– ভূতের বাড়ি বুঝি?
– লোকে তো তাই বলে।
– আপনি কী বলেন, এখানে ভূত থাকে?
লোকটি এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে বাগানের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। হঠাৎ একটি কালো বিড়াল দৌড়ে এসে অদ্ভুত চোখে সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠলো-মিঁউ!…’’ গল্পের এখানটায় আবারও বিড়ালের ‘মিঁউ’ ডাক শুনতে পেলেন নীতিশ বাবু। নীতিশ বাবু শিহরিত হলেন। গায়ে পশমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। মুখ শুকিয়ে কাঠ হল। ব্যাগের পকেট থেকে বোতল নিয়ে ঢক-ঢক করে পানি খেলেন তিনি। তারপর সতর্ক দৃষ্টি মেললেন চারদিকে। এবার অবিরত বিড়ালের অস্পষ্ট ডাক শুনতে পেলেন তিনি।
ট্রেনের জানালার দিকে তাকালেন নিতীশ বাবু। হঠাৎ বুকটা ধক করে উঠলো তার। জানালার পাশেই একটি বিড়াল দেখতে পেলেন তিনি। কালো রঙের বেশ মোটাসোটা একটি বিড়াল। মেয়েরা যেমন মাথায় ঘোমটা দেয়, তেমনি ঘোমটা পরা বিড়ালটির চোখ দুটি টকটকে লাল। বিড়ালটি নীতিশ বাবুর দিকে তাকিয়ে একটানা ডেকে যাচ্ছে মিঁউ-মিঁউ-মিঁ…উ…।
জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন নীতিশ বাবু। যখন জ্ঞান ফিরে পেলেন তখন তার মনে হলো অনেক লোক তার চারপাশে ঘিরে আছে। কতজনে কত কথা জিজ্ঞেস করছে- কী হয়েছিলো আপনার? কেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন? আপনি কি অসুস্থ? কোথায় যাবেন এখন, ইত্যাদি-ইত্যাদি প্রশ্নে দিশেহারা হয়ে পড়লেন তিনি। নীতিশ বাবু কারও প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারলেন না। কীভাবে উত্তর দেবেন? সত্যিকার অর্থে ট্রেনের কামড়ায় নীতিশ বাবু ছাড়া আর তো কেউ নেই! তাহলে এতো এতো লোকের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর কীভাবে শুনতে পেলেন তিনি? নীতিশ বাবুর এর উত্তর জানা নেই। তিনি খুব ভয় পেলেন। ভয়ার্ত চোখে তিনি ট্রেনের জানালার দিকে তাকালেন আবার। তখনও তিনি বিড়ালটিকে দেখতে পেলেন জানালার পাশে তেমনি ঘোমটা দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে!
নীতিশ বাবু ‘না-না’ বলে দুই কান চেপে ধরে আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
তারপর কতটা বছর কেটে গেলো নীতিশ বাবুর। বিয়ে করলেন। সংসার হলো তার। ছেলেমেয়েরা এখন বেশ বড় হয়েছে। চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করার পর মনে হল এবার ঝইঝঞ্ছাট ঝেড়ে ফেলে বাকিটা জীবন এখানে-ওখানে ঘুরে-ফিরে কাটিয়ে দেবেন। অবসরে একদিন কালো বিড়ালের সেই রাত্রির কথা মনে পড়ল তার। খুব ইচ্ছে হল ট্রেনে চেপে চাকরির প্রথম পোস্টিংয়ের জায়গাটা দেখে আসবেন। সেখানের বন্ধুদের যদি খুঁজেও দেখতে পারেন। পরিকল্পনা মতো চল্লিশ বছর পর আবারও তিনি ট্রেনে চেপে বসলেন রাতের প্যাসেঞ্জার হয়ে।
নীতিশ বাবুর জীবনে পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। আবারও ট্রেনের কামড়ায় একা হলেন তিনি। তখন গভীর রাত। নীতিশ বাবু ট্রেনের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেই কালো বিড়ালটি তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে অনবরত ডেকে যাচ্ছে মিঁউ-মিঁউ-মিঁউ…। এবার আর নীতিশ বাবু জ্ঞান হারালেন না। বয়স হলে মানুষের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়, নীতিশ বাবুরও তাই হয়েছে। সেও অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলেন লাল চোখের কালো বিড়ালটির দিকে।