তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, (সুনামগঞ্জ) সীমান্ত থেকে ফিরে : ‘সবুজের বুকে লাল, সুর্যটা ঝল্মল উজ্জ্বল প্রাণেরও বন্যা’ দেশের গানের মনোরম এমন নজনকাড়া দৃশ্য পাহাড়ের পাদদেশে। মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জবাসীর অনন্য ভূুমিকা ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান, ইতিহাসের পাতায় গৌরবের অধ্যায় হিসেবে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।

সুনামগঞ্জের সীমান্ত ঘেরা মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের সম্মানে দাঁড়িয়ে আছে বাঁশতলা-হকনগর শহিদ স্মৃতিসৌধ। এটি দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থিত। সুনামগঞ্জের অন্যতম পর্যটন এলাকা হিসেবে যে ক’টি পর্যটন স্থান ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে তার মধ্যে এটিও একটি। রুচিশীল প্রকৃতি প্রেমিদের নজরকাড়া পাহাড়ী মনমাতানো এই দৃশ্য পর্যটকদের হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়তই।

ভারতীয় সীমানার কোলঘেঁষা বাংলাদেশের জুমগাঁও গারো পাহাড়ে অবস্থান অন্তত দু’শ বছরের পুরোনো আদিবাসী ছোট্ট এক পাহাড়ী গ্রাম। প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন হাজারো প্রকৃতিপ্রেমি এখানে ছুটে যাচ্ছেন। জুুমগাঁও গ্রামে আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের প্রায় ২৬টি পরিবারের বসবাস করে। এই এলাকার চারদিকে সবুজের হাতছানি। শেষ বিকেলে পাখির কলকাকলী ও বিকেলর মিষ্টি রোদে মৃদু বাতাস প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। বিস্তৃর্ণ এলাকায় ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়ে সাজানো দৃশ্য নজরকাড়া। এখানের পাহাড়ী ঝর্ণা চোখে পড়ার মতো। হকনগররে মৌলা নদীর উপর স্লুইচগেটটি দেখতে প্রায় জলপ্রবাহের মতোই। পাহাড়ি ঝর্ণার মাঝে এ স্লুইচগেট আলাদা সৌন্দর্য্যরে সৃষ্টি করেছে। এখানে ঠান্ডা ও শীতল স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটলে সহজেই শরীরের ক্লান্তি দূর করে। স্লুইচ গেটে পানির ঝিরঝির শব্দে গোটা এলাকা যেন মুখরিত হয়ে আছে। এই স্লুইচ গেট পেরিয়ে একটু সামনে গেলেই দেখা যাবে পাহাড় ঘোঁষা এই ‘শহীদ স্মৃতিসৌধ’টি। এখনাকার আশপাশের পরিবেশ খুবই শান্ত ও মনোরম। সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশ যেন মিতালী পেতেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন হয়ে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের সমতলে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাঁশতলা-হকনগর শহীদ স্মৃতিসৌধ মুক্তিযুদ্ধের এক উপত্যকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ নং সেক্টরের চেলা (বাঁশতলা) সাব-সেক্টর সদর দপ্তর ছিল এটি। এ সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন এ. এস. হেলাল উদ্দিন। পরবর্তী ছিলেন লে. আব্দুর রউফ ও লে. মাহবুব। এ সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনায় ঘনিষ্ট সহযোগিতা করেন এম. এন. এ. অব্দুল হক, শহিদ চৌধুরীসহ আরো অনেকে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে দেশব্যাপি অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে এম. এন. এ হক বাঁশতলা এলাকায় সমবেত হন। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে ডা. হারিছ আলী, হেমেন্দ্র দাস পুরকায়স্থ, ডা. আব্দুল মছব্বির (বাঁশতলা) হাজী মফিজ আলী (বড়খাল), সামছুল হক চেয়ারম্যান (বাংলাবাজার), আব্দুল কাদির ও নয়ন ডাক্তার (নরসিংপুর) ডা. আহসান উল্লাহ (ভাংগাপাড়া), ডা. আব্দুল হামিদ (টেংরাটিলা) মদন মোহন নন্দী (হাসাউড়া), আব্দুল কাদের মেম্বার (কান্দাগাঁও), আলী আহম্মদ (বাংলাবাজার), আব্দুর রইছ চৌধুরী (লক্ষ্মীপুর) প্রমুখ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বাঁশতলায় উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাঁশতলাসহ এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় যারা শহীদ হয়েছেন তাদের এখানেই চিরন্দ্রিায় সমাহিত করা হয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সামছু মিয়া চৌধুরী এমপি’র উদ্যোগে এখানকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর পাকা করা হয়। পরবর্তীতে এ সকল শহীদের স্মৃতি অ¤øমøান করে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেলা (বাঁশতলা) সাব-সেক্টর কমান্ডার এ. এস. হেলাল উদ্দিন হকনগর শহীদ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন।

এটি একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে এখন ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছে। পরবর্তীতে সরকারী অর্থায়নে হকনগর স্মৃতি সৌধ এলাকায় পর্যটকদের জন্যে নির্মাণ করা হয় রেষ্ট হাউজ, হকনগর কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা। চেলা (বাঁশতলা) সাব-সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী, আব্দুল হালিম ও আব্দুল মজিদ ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর, ছাতকের প্রয়াত এম. এন. এ আব্দুল হক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ কালীন ৫নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধে এলাকায় তাঁর বিশেষ অবদানের জন্যে পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারে গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘হকনগর’। প্রয়াত আব্দুল হক (এম. এন. এ হক) এর নামানুসারে হকনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হকনগর গ্রাম ও হকনগর স্মৃতিসৌধসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ৫নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা, জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল হকের কবর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাঁশতলা-হকনগর শহিদ স্মৃতিসৌধে স্থানান্তরিত করা হয়। ওই দিন সীমান্তের জিরো পয়েন্ট শহিদ স্মৃতিসসৌধ এলাকায় উৎসুক জনতার উপচেপড়া ভীড় জমে। উপস্থিত সকলেই লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বীর সেনানীদের প্রতি বিন¤ª শ্রদ্ধা জানিায়ে ছিলেন হকনগর শহিদ স্মৃতিসৌধে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঁশতলার এই মাঠে তাবু করে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পরই তিনি এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।