থাইংখালী ১৯ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মায়ের কোলে এরদোগান। ছবি-হুমায়ুন কবির জুশান     

হুমায়ুন কবির জুশান, উখিয়া (কক্সবাজার) : এরদোগানের জন্ম বাংলাদেশে। সাড়ে চার বছর ধরে এ দেশের আলো বাতাসে বেড়ে উঠছে। থাইংখালী ১৯ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে বাবা-মা, দাদা-দাদি ফুফা-ফুফি ও অন্যান্য আত্নীয়-স্বজনদের সাথে।

এরদোগান যখন ৯ মাসে তার মায়ের গর্ভে ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে মিয়ানমার সেনা বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে তিন দিন তিন রাত পাহাড়-পর্বত খাল-বিল ও নাফ নদী পেরিয়ে পায়ে হেটে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মায়ের প্রচন্ড ব্যথা যন্ত্রণা ও পেটে ক্ষুধা আর কষ্ট নিয়ে স্ব-দেশের মায়া ত্যাগ করে অনিশ্চিয়তার পথে যাত্রা।

অবশেষে ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় খুঁজে পায়। রোহিঙ্গাদের আগমণে সর্বপ্রথম স্থানীয়রাই রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ান। পরে এনজিও ও বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। প্রথম থেকেই রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন তুরস্ক। সেই দেশের ফাস্ট লেডি এ্যামিনি রোহিঙ্গাদের দেখতে আসেন। সেই থেকে রোহিঙ্গাদের কাছে এরদোগান ও এ্যামিনি নামটি অতি পরিচিত।

তাজনিমারখোলা ১৯ নং ক্যাম্পের পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রয় নেয়ার ১৩ দিন পর এরদোগান জন্মগ্রহণ করেন।

ঠিক সেই সময়ে এই প্রতিবেদক মানবিক সহযোগিতা ও রোহিঙ্গাদের সংবাদ সংগ্রহ করতে সেখানে উপস্থিত হই। ১০০ গজের মাথায় একই সময়ে দুই রোহিঙ্গা নারী সন্তান প্রসব করেন। কোন প্রকার ডাক্তার নার্স ছোড়াই। রোহিঙ্গাদের ছোট্ট কুড়ে ঘর আলোকিত করে এক জনের ঘরে ছেলে অন্য জনের ঘরে মেয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। আমি ঐ ঘরের পাশ দিয়ে যেতেই নব জাতকের কান্না শুনতে পাই। তখন তাদের ঘরে কিছুই ছিল না। আমি আমার বন্ধুদের সহায়তায় সেদিন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। এরা আবেগাপ্লুত হয়ে এই সন্তান দুটির নাম রাখতে আমাকে অনুরোধ করেন। আমি ছেলে-মেয়ে দুজনকে কোলে নিয়ে দোয়া করি এবং ছেলের নাম এরদোগান আর মেয়ের নাম এ্যামিনি রাখার প্রস্তাব করলে সকলে খুশি মনে এরদোগান ও এ্যামিনির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এ নাম রেখে দেয়।


পানির কলে খেলা করছে এরদোগান। ছবি-হুমায়ুন কবির জুশান      

অবশেষে গতকাল সংবাদ সংগ্রহের জন্যে ১৯ নং ক্যাম্পে গেলে এরদোগান ও এ্যামিনির কথা মনে পড়ে যায়। ঠিক সেই পাহাড়ের উঁচুতে গিয়ে কয়েক রোহিঙ্গা নারীর কাছে এরদোগানের কথা জানতে চাইলে তারা আমাকে চিনতে পারে। এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, আপনি চার বছর আগে আমাদের ঘর তৈরি করে দিয়ে নলকুপ দিয়েছিলেন। সামনের মসজিদ আপনি করেছেন এবং এরদোগান ও এ্যামিনির নাম আপনি রেখেছেন। এ কথা বলে পাহাড় থেকে নেমে গেলেন ঐ নারী। অল্পক্ষণ পর এরদোগান ও তার মাকে নিয়ে আসলেন।

এরদোগানের মা শফিকা বলেন, আমি যেন আজ বহু বছর পর আমার ভাইকে দেখতে পেলাম। যে ভাই কঠিন বিপদের সময়ে বোনকে সাহায্য করেছেন। আপনার দেয়া নামই আমার ছেলের নাম এরদোগান। আজ কত বড় হয়েছে দেখেন। এ দেশে আশ্রয় নেয়ার ১৩ দিন পর এরদোগানের জন্ম। আমি এ্যামিনিকে দেখতে চাইলে সে তার বাবা মায়ের সাথে ক্যাম্প ২০ এ আছেন বলে জানান।

এরদোগানকে দেখতে পেলেও এ্যামিনিকে দেখতে না পাওয়ার ব্যদনায় চলে আসতে হলো। এরদোগানের দাদি, ফুফি ও অন্যান্যরা জানান, এরদোগান এখন মক্তবে আরবি পড়তে যায়। সে এ দেশেই জন্ম গ্রহণ করেছেন। তার প্রতি আপনারা খেয়াল রাখবেন। আমরা এ দেশের মানুষের কাছে কৃতঞ্জতা প্রকাশ করছি। এখানে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জন্যে জায়গা দিয়ে বাড়ি তৈরি ও শিশুদের শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা নিয়মিত খাবার পায়। তবে শীতে শীতবস্ত্র তেমনটা পায়নি। রোহিঙ্গাদের জীবন মান আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে।